তিনজনের ডিএনএ নিয়ে জন্মাল শিশুটি

0
79
ডিএনএ

যুক্তরাজ্যে প্রথমবারের মতো তিনজনের ডিএনএ নিয়ে এক শিশুর জন্ম হয়েছে। ওই শিশুর এখন জৈবিক মা–বাবা তিনজন। দেশটির প্রজনন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই শিশুর বেশির ভাগ ডিএনএ এসেছে তার মা–বাবার কাছ থেকে। আর প্রায় শূন্য দশমিক ১ শতাংশ এসেছে একজন ডিএনএদাতা নারীর কাছ থেকে। এই পরিবারকে যেন কেউ শনাক্ত করতে না পারে, এ কারণে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। তথ্যের স্বাধীনতা চেয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সীমিত এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।

মানবশরীরের প্রায় প্রতিটি কোষে থাকা একটা ছোট্ট অংশের নাম মাইটোকন্ড্রিয়া, যা খাদ্যকে শরীরে ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে পরিণত করে। কিন্তু মায়ের শরীর থেকে ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকন্ড্রিয়া সন্তানের শরীরে যেতে পারে। আর এ ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকন্ড্রিয়া সন্তানের মস্তিষ্কের ক্ষয়, পেশি কোষের ক্ষয় থেকে শুরু করে অন্ধত্ব তৈরি এমনকি হৃৎপিণ্ড বিকল করতে পারে। মায়ের কাছ থেকে সন্তানের শরীরে জটিল জিনগত রোগের বিস্তার ঠেকাতেই মূলত এ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। আর যুক্তরাজ্যই এক সন্তানের তিন জৈবিক মা–বাবার বিধান পাস করা প্রথম দেশ। এ ধরনের পাঁচটিরও কম শিশুর জন্ম হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ নিরাময়–অযোগ্য। শিশু জন্মের কয়েক দিন বা এমনকি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এই রোগে কিছু পরিবার একাধিক সন্তান হারিয়েছে। এমন পরিবারে একটি সুস্থ সন্তান নেওয়ার একমাত্র বিকল্প এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

মায়ের কাছ থেকে সন্তানের শরীরে জটিল এই জিনগত রোগের বিস্তার হয়। এ কারণে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডোনেশন চিকিৎসা ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের (আইভিএফ) একটি পরিবর্তিত রূপ। এতে একজন সুস্থ নারী দাতার ডিম্বাণু থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া ব্যবহার করা হয়। মাইটোকন্ড্রিয়া দান করে এই পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেওয়ার দুটি কৌশল রয়েছে। একটি ঘটে বাবার শুক্রাণুর মাধ্যমে মায়ের ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার পরে আর অন্যটি নিষিক্ত হওয়ার আগে ঘটে।

মাইটোকন্ড্রিয়ার নিজস্ব জিনগত তথ্য বা ডিএনএ আছে। এই পদ্ধতিতে শিশুরা তাদের মা–বাবার কাছ থেকে এবং একজন দাতার কাছ থেকেও উত্তরাধিকারসূত্রে ডিএনএ পায়। এটি একটি স্থায়ী পরিবর্তন, যা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝেও থেকে যাবে।

মাইটোকন্ড্রিয়া রোগে আক্রান্ত নারীরা সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা নিতে পারেন। এতে সন্তান জন্মদানে ইচ্ছুক নারী-পুরুষের ডিএনএর সঙ্গে সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়ার অধিকারী আরেক নারীর কাছ থেকে ডিএনএ নেওয়া হবে। এভাবে জন্ম নেওয়া সন্তান জৈবিক মা–বাবার ডিএনএর পাশাপাশি দাতা নারীর ডিএনএর মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পাবে। এতেই শিশুটি ত্রুটিপূর্ণ মাইটোকন্ড্রিয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা অব্যাহত থাকবে। এই দাতা ডিএনএ শুধু কার্যকর মাইটোকন্ড্রিয়া তৈরি করে। তবে এতে শিশুর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেমন চেহারাকে প্রভাবিত করে না।

যুক্তরাজ্যের নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা প্রথম এই চিকিৎসা-পদ্ধতিতে সাফল্যের দাবি করার পর ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি চায়। ‘থ্রি-পারসনস বেবি’ নামে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এই বিল শেষ পর্যন্ত হাউস অব কমন্সে গড়ায়। এমপিদের বলা হয় তাঁরা যেন দলীয় নীতি চিন্তা না করে এই প্রস্তাবের ‘নৈতিক দিক’ বিবেচনা করে ‘বিবেকের’ সাড়ায় এ ভোটে অংশ নেন। পরে ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতারা এই পদ্ধতি প্রয়োগের অনুমোদন দেন। তবে আইন পাস হলেও শুরুতে যুক্তরাজ্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেনি। এ পদ্ধতিতে প্রথম শিশুর জন্ম হয় ২০১৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিত্সা নেওয়া জর্ডানের একটি পরিবারে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রথম শিশুর জন্ম হয়।

যুক্তরাজ্যের হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজি অথরিটি (এইচএফইএ) বলেছে, চলতি বছরের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে পাঁচটিরও কম শিশুর জন্ম হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের প্রোগ্রেস এডুকেশনাল ট্রাস্টের পরিচালক সারাহ নরক্রস বলেন, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে দান করা মাইটোকন্ড্রিয়া নিয়ে এখন যুক্তরাজ্যে অল্পসংখ্যক শিশু জন্ম নেবে। মাইটোকন্ড্রিয়া দানের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও মূল্যায়ন ও পরিমার্জন করে ধীর ও সতর্ক থাকতে হবে।

এ বিষয়ে এখনো নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এ কারণে পদ্ধতিটি পুরোপুরি সফল হয়েছে কি না, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক রবিন লাভেল–ব্যাজ বলেন, মাইটোকন্ড্রিয়া প্রতিস্থাপন থেরাপি কৌশলটি ব্যবহারিক পর্যায়ে কতটা ভালোভাবে কাজ করেছে, এতে শিশুরা মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ থেকে মুক্ত কি না এবং কোনো ঝুঁকি আছে কি না, তা জানাটা এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। এসব শিশুর পরবর্তী জীবনে কোনো সমস্যা দেখা দেবে কি না, তা–ও দেখতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.