শেষ সময়ে ভোটের হিসাব-নিকাশ নিয়ে আলোচনা। সব প্রার্থীর নজর বিএনপির ‘ভোটব্যাংকের’ দিকে।
নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচার-গণসংযোগে গতকাল শনিবার বরিশাল শহর ছিল সরগরম। প্রচার শেষে সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কে হতে যাচ্ছেন। বিএনপি এই নির্বাচনে নেই। কিন্তু ভোটের হিসাব-নিকাশে বিএনপির ‘ভোটব্যাংকের’ দিকেই সবার নজর।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কখনো ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী সৈয়দ ফয়জুল করিম, কখনোবা সাবেক মেয়র আহসান হাবীব কামালের ছেলে কামরুল আহসান ওরফে রূপণের নাম এসেছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেনও মাঠে আছেন।
খায়ের আবদুল্লাহর বিপরীতে থাকা তিন প্রার্থীই আওয়ামী লীগ বা সরকারবিরোধী ভোট টানবেন, সাধারণভাবে এমনটাই ধারণা করা হয়। সে হিসেবে বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে যতটা নির্ভার থাকার কথা, সেটা পারছে না। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলছেন, তাঁদের একটা উদ্বেগ হচ্ছে, সরকারি দলকে হারানোর মনোভাব নিয়ে বিরোধী দলের সমর্থকেরা নীরবে এক জোট হয়ে যান কি না এবং সবাই কোনো একজন প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে পড়েন কি না। যেমনটা গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের মায়ের ভোটের ক্ষেত্রে হয়েছিল বলে মনে করেন সেখানকার নেতারা।
বিএনপির ভোটব্যাংক শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যাবে, এ নিয়ে গতকাল দিনভর বরিশালে নানা রকম আলোচনা ছিল চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত। শহরের বাংলাবাজার মোড়ের চা–দোকানি বাবুল গাজী ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার। গতকাল বিকেলে তাঁর দোকানে বেশ কয়েকজন চা পান করছিলেন। দোকানি ও ক্রেতা—সবাই ভোটের আলাপে ব্যস্ত। কার পাল্লা ভারী, তা নিয়ে একেকজন একেক মন্তব্য করছেন। বাবুল গাজী বলেন, ‘যা-ই বলেন, শেষমেশ নৌকাই পাস করবে।’ চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন রিকশাচালক আবুল কালাম। তিনি পাল্টা মন্তব্য করলেন, ‘যা হুনি বুঝি, তা অইলো, বিএনপি যে দিকে যাইবে, হেই পাল্লা ভারী অইবে। হ্যার লগেই কনটেস্ট অইবে নৌকার।’
অবশ্য ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনের সময় কে জিতবে, কে হারবে—এমন মন্তব্য প্রকাশ্যে করতে দেখা যায়নি। এবার ব্যতিক্রম। ভীতির সঞ্চার হতে পারে, তেমন পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। যারা ভীতি তৈরি করতে পারে, তাদের এবার সেভাবে মাঠে দেখাও যাচ্ছে না। নির্বাচনের প্রচার শান্তিপূর্ণ হওয়ায় ভোটের দিনের পরিবেশ নিয়ে খুব একটা শঙ্কার কথাও শোনা যাচ্ছে না। এ কারণেই ভোটের হিসাব-নিকাশটা আলোচনায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিএনপির ভোট নিয়ে কেন আলোচনা
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের অতীতেও তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০১৩ সালে সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেন (হিরণ)। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি এগিয়ে ছিলেন বলেই মনে করা হতো। সেই শওকত হোসেনকে ১৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন তখনকার বিএনপির মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল। অবশ্য ওই সময় এমন অভিযোগও উঠেছিল যে দলে শওকত হোসেনের দাপট কমাতে আওয়ামী লীগেরই একটা অংশ ভেতরে–ভেতরে বিরোধীদের সহায়তা করেছে। এবার সে রকম কিছু হলে বিপাকে পড়তে হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়ের আবদুল্লাহকে।
এবার ভোটের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বাইরে চোখে পড়ার মতো তৎপরতা ও প্রচারে দেখা গেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী সৈয়দ ফয়জুল করিমকে। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতাকে জেতাতে আটঘাট বেঁধে নেমেছে ইসলামী আন্দোলন। বিএনপির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের একাংশের ভোটের দিকেও নজর ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন প্রচারে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর ভাই জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক এইচ এম তসলিম উদ্দিন। ভাইয়ের কারণে বিএনপি সমর্থকদের একাংশের ভোট ইকবাল পেতে পারেন বলে আলোচনা আছে।
এঁদের পাশাপাশি ভোটের মাঠে আলোচনায় আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসানও। সাবেক ছাত্রদল নেতা ও সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল প্রচার চালিয়েছেন অনেকটা নীরবে। কামরুলের ঘনিষ্ঠদের মতে, স্বতন্ত্র হলেও কামরুল দিন শেষে বিএনপি পরিবারের সন্তান। নীরব প্রচারে তাঁরা এটাই বলার চেষ্টা করেছেন।
বিএনপির ভোটব্যাংক নিয়ে কেন এত আলোচনা—এ প্রসঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকদের ভাষ্য, ২০০৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনায়েত পীরকে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপির মজিবুর রহমান সরোয়ার। ওই নির্বাচনে বিএনপির আরও দুই প্রার্থী অংশ নেওয়ায় তাঁদের সম্মিলিত ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল অর্ধেকের কম।
এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শওকত হোসেন বিজয়ী হলেও ভোটের ব্যবধান ছিল ৫৮৪। যেখানে বিএনপি নেতা সরফুদ্দিন আহমেদ ছিলেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এই নির্বাচনে বিএনপির আরও দুই প্রার্থী ছিলেন। বিএনপির তিন প্রার্থী মিলে শওকত হোসেনের দ্বিগুণ ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রায় ১৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হারলেও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এ কারণে এই নির্বাচনেও বিএনপি সমর্থক ভোটারদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে।
শেষ সময়ে অভিযোগ
গতকাল আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ নগরের সিঅ্যান্ডবি সড়ক, চৌমাথা, নবগ্রাম রোড ও সদর রোডে গণসংযোগ করেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী কাউনিয়া, বিসিক এলাকায় ও কলাপট্টি এলাকায় এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী নগরের চাঁদমারি এলাকায় গণসংযোগ করেন।
সকালে নগরীর পোর্ট রোড এলাকায় গণসংযোগ করেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ফয়জুল করিম। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ ভোটে জিততে পেশিশক্তি ও কালোটাকার ব্যবহার করছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান গতকাল দুপুরে বরিশাল প্রেসক্লাব মিলনায়তনে নিজের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর তিন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার রাতে তাঁর প্রচারের মাইক ভাঙচুর করা হয়েছে। নানা মাধ্যমে তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
একজন প্রার্থীর পক্ষে সরকারি লোকজন কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন। এই অভিযোগের বিষয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এই অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই। আজই প্রথম শুনলাম।’ তিনি গণমাধ্যমে অভিযোগ না করে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দেন।
এ নির্বাচনে মেয়র পদে মোট প্রার্থী সাতজন। বাকি তিন প্রার্থী জাকের পার্টির মিজানুর রহমান, স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান ও মো. আলী হোসেন হাওলাদার সেভাবে আলোচনায় নেই।
এই নির্বাচনের প্রচার শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ায় ভোটারদের মধ্যে একধরনের স্বস্তি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম। তিনি বলেন, প্রার্থীরা কিছু অভিযোগ করলেও গুরুতর কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুষ্ঠু ভোটের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই পরিবেশ ভোটের দিনও বজায় থাকলে ভোটাররা উৎসাহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন বলে মনে হচ্ছে।