বরিশালে ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যু ও আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। গতকাল শনিবার সকাল ছয়টা থেকে আজ রোববার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে আরও তিন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনে বরিশালে ডেঙ্গুতে ৩৫ জনের মৃত্যু হলো। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সংকট কাটেনি শিরায় দেওয়া স্যালাইনের। ফলে বিপাকে আছেন রোগী ও স্বজনেরা।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভাগে নতুন করে হাসপাতালে এসেছেন ৪৫৮ জন। এটি এক দিনে এ বছরের সর্বোচ্চ আক্রান্তের রেকর্ড। এ নিয়ে বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১৯ হাজার ৬৩৪–এ। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৫ জন। রোববার সকাল পর্যন্ত বিভাগের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন ১ হাজার ২২৫ জন।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়, সর্বশেষ ডেঙ্গুতে বিভাগে মারা গেছেন তিনজন। এর মধ্যে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার পিয়ারা বেগম (৭০) শনিবার বিকেলে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে মারা যান। নেছারাবাদ উপজেলার মমতাজ বেগম (৬০) মারা যান রোববার রাতে নেছারাবাদ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তারেকুল ইসলাম (৭০) নামের অপর ডেঙ্গু রোগী মারা যান তাঁর নিজ জেলা ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তিনি একই উপজেলার কুতুবা গ্রামের বাসিন্দা। মারা যাওয়া তিনজনই স্থানীয়ভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁরা সবাই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
শনিবার দুপুরে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা পুরো ডেঙ্গু ইউনিট। বিভাগের ছয়টি জেলা ছাড়াও পাশের মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা থেকেও অনেক ডেঙ্গু রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এ হাসপাতালের মেডিসিন ইউনিটের পাঁচতলা ভবনটির দুটি তলায় প্রথমে ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়। পরে রোগী সামলাতে পুরো ভবনটিতেই ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শয্যা না পেয়ে অনেক রোগী বারান্দা ও শৌচাগারের সামনে বিছানা পেতে ঠাঁই নিয়েছেন।
ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে শিরায় দেওয়া স্যালাইনের সংকট এখনো কাটেনি। রোগী ও স্বজনেরা জানিয়েছেন, তাঁদের কারও কারও বাইরে থেকে স্যালাইন কিনে আনতে হচ্ছে। বাইরে ওষুধের দোকানগুলোতে স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না। দু-একটি দোকানে পাওয়া গেলেও বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে।
ওষুধের দোকানমালিকেরা জানান, ৫০০ মিলিলিটার এনএস স্যালাইনের খুচরা বিক্রয়মূল্য ৬৭ টাকা আর এক হাজার মিলিলিটারের দাম ৮৭ টাকা।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর স্বজন পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বাইরের দোকানগুলোতে স্যালাইন নেই। তিনি অনেক ঘুরে শনিবার দুটি স্যালাইন কিনেছেন। তা–ও দেড় শ টাকা করে দিতে হয়েছে।
চিকিৎসকদের ভাষ্য, ডেঙ্গু রোগীর মূল চিকিৎসাই হচ্ছে ‘ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট’। রোগীর শরীরে যাতে পানিস্বল্পতা রোধ করা যায়, সে জন্য স্যালাইন অত্যাবশ্যকীয়। ডেঙ্গু রোগীদের মূল ঝুঁকির সময়টা হচ্ছে জ্বর কমে যাওয়ার পর চার থেকে পাঁচ দিন। এ সময় রোগীর রক্তচাপ একেবারে নেমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে হৃদ্যন্ত্র স্থবির হয়ে রোগী মারা যেতে পারে। এ সময় রোগীর রক্তচাপ ঠিক রাখতে হলে স্যালাইন খুবই জরুরি।
রোববার বিকেলে স্যালাইনের সংকটের বিষয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তাই উৎপাদন ও সরবরাহ কিছুটা শ্লথ হওয়ায় তাঁদের মজুতে কিছু ঘাটতি হয়েছে।
মেহেদী হাসান নামের এক যুবক বলেন, ৯ দিন আগে তাঁর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। পিরোজপুর হাসপতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর তাঁর প্লাটিলেট ৫৬ হাজারে উঠলে তাঁকে হাসপাতাল থেকে নাম কেটে বাড়ি পাঠানো হয়। এরপর পরীক্ষা করে দেখেন, তাঁর প্লাটিলেট ২৬ হাজারে নেমে গেছে। পরে শুক্রবার এই হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে আসার পর তাঁকে বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে হয়েছে।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান বলেন, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের কয়েকটি উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবেই অনেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার রোধে এখন ব্যক্তি পর্যায়ে সুরক্ষা, সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।