দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভারতীয় সংগীতজগতে রাজত্ব করেছেন শান। বলিউডের রোমান্টিক, মিষ্টি মেলোডি গানগুলোর পেছনে তাঁর কণ্ঠ জাদু ছড়িয়েছে। ‘তানহা দিল’, ‘ভুলা দেঙ্গে’, ‘চান্দ সিফারিশ’, ‘জব সি তুঝকো দেখা’, ‘ও হামসাফার’ গানগুলো এখনো শ্রোতাদের মুখে শোনা যায়। হিন্দি ছাড়াও বাংলা, মারাঠি, তেলেগু, কন্নড়, তামিল, ওড়িয়াসহ বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন শান। এই সংগীত তারকার বড় ছেলে মাহি মুখার্জি বাবার পথ অনুসরণ করেই সংগীতজগতে নিজের জায়গা তৈরি করছেন। তিনি এখন নিজের গান নিজে সুর করেন। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত জেন-জিদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। সম্প্রতি ভারতীয় বিনোদনবিষয়ক গণমাধ্যম মাসালাডটকমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মাহি তাঁর গান, বাবার উত্তরাধিকারসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।

মাহির সাম্প্রতিক কাজ
দুই সপ্তাহ আগে ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছে মাহির গান ‘জান সে য্যায়দা’। যদিও এর অডিও সংস্করণ আগেই মুক্তি দিয়েছিলেন, এবার নিয়ে এলেন ভিডিও চিত্র। গানটি নিয়ে মাহি বলেন, ‘এটা একটা খুব বিশেষ ভিডিও। আমি এটা শুট করেছি আমার সহ-অভিনেত্রী আদ্য আনন্দের সঙ্গে। সে দারুণ অভিনয় করেছে। তবে এ ভিডিওর বিশেষত্ব হলো, এতে আমার বাবা-মা, শান ও রাধিকা অতিথি হিসেবে হাজির হয়েছেন। ভিডিওর শেষ দিকে তাঁরা যেখানে আসেন, সেখানে একটা মজার টুইস্ট আছে। আমি এ ভিডিও নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। আমি চাই, দর্শকেরা এটি দেখুন। এই মিউজিক ভিডিওতে আমি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের গল্প দেখাতে চেয়েছি। এটা এমন এক ভিডিও, যা অনেক দিন আমার স্মৃতিতে থাকবে।’
গান রেকর্ডের প্রক্রিয়া
ইন্ডাস্ট্রিতে নবাগত মাহি তাঁর গান রেকর্ডিংয়ের সময় ও প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, তিনি এখনো গান একবারে শেষ করতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমি এখনো একটানে গান রেকর্ড করিনি। আমি অটো টিউন ব্যবহার করি। একেবারে গান রেকর্ড করার পর্যায়ে যেতে আমাকে আরও রেওয়াজ করতে হবে, অনুশীলন করতে হবে।’ তিনি নিজের রেকর্ডিংয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও বলেন, ‘প্রথমে একটা মনিটর মিক্স হয় স্টুডিওতে, যেখানে সবকিছু শোনা হয়, ভোকাল ঠিক লাগছে কি না, সব ঠিকঠাক আছে, নাকি পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। গান তৈরির ক্ষেত্রে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমার মনে হয়, গানের এই অংশটুকুতে আমরা

সবচেয়ে বেশি সময় দিই।’
এই সাক্ষাৎকারে হালের আলোচিত ‘জান সে য্যায়দা’ গান নিয়ে কথা বলেন মাহি। তিনি জানান, তাঁরা গানটিতে একটা লাইভ অ্যাকুয়াস্টিক গিটার ব্যবহার করেছেন তাঁরা। কারণ, তাঁরা চেয়েছিলেন একটু ‘র’ সাউন্ড। নিজের দল সম্পর্কে মাহি বলেন, ‘কখনো কখনো নিজের কাজ নিয়ে বেশি চিন্তা করি। ঠিক করলাম কি না, ভুল হলো কি না। এ সময় একটা শক্তিশালী টিমের দরকার হয়, যারা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আশ্বস্ত করে, “তুমি ঠিক করছ।” এই জিনিসটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’
নতুন প্রজন্মের পছন্দ
মাহি বাবা শানের উত্তরাধিকার বহন করলেও তিনি জেন-জি প্রজন্মের প্রতিনিধি। এই সময়ের ছেলেমেয়েরা বলতে গেলে তাঁর গানে বুঁদ। সংগীত তৈরির ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের শ্রোতাদের কথা আলাদাভাবে মাথায় রাখেন কি না, জানতে চাইলে মাহি বলেন, ‘একটা ভালো দিক হলো, যে ধরনের গানই হোক না কেন, তা যদি মন থেকে করি, অন্যের কপি না করি, তাহলে সংগীতের সব ধারার প্রতিই সম্মান জানানো হয়। আমার নিজের স্টাইলও সেই রকম, একটু রেট্রো ঘরানার। আমার কণ্ঠের একটা অংশ দুর্বল, সেটা আমার গানগুলোতে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে।’

তাঁর প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কী ধরনের গান শুনতে পছন্দ করেন? আলাপে আলাপে সে কথাও জানিয়েছেন তরুণদের পছন্দের এই শিল্পী। ‘আমাদের প্রজন্ম চায় “জেনুইন” হওয়া। আমরা গানে প্রধানত এ জিনিস খুঁজি। গান আসল না হলে সেটা আমাদের কানে ধরা পড়ে। আমরা সেটা ভালোই বুঝতে পারি। সংগীত আসলে চিরন্তন ব্যাপার। ২০ বছরের পুরোনো অনেক গান আছে, আমার মনে হয়, যেটা আজও মুক্তি পেলে একইভাবে চলবে।’
বলিউডে মাহি
চলতি বছর বলিউড সিনেমা ‘নাদানিয়াঁ’-এর একটি গানে কণ্ঠ দিয়ে হিন্দি সিনেমার প্লেব্যাকে অভিষেক হয়েছে মাহির। ছবির ‘তেরা ক্যা করু?’ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। গানটিতে পর্দায় দেখা গেছে সাইফ আলীর খানের ছেলে ইব্রাহিম আলী খানকে। মুম্বাইয়ে ছবির বিশেষ প্রদর্শনীতে হাজির হয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ২২ বছর বয়সী সংগীতশিল্পী। সেদিন তিনি বলেনছিলেন, ‘শৈশবে বাবার তৈরি গান শুনে বড় হয়েছি, বিশেষ করে যেগুলো তিনি সাইফ স্যারের জন্য গাইতেন। আজ নিজেই এই যাত্রার অংশ হতে পারাটা স্বপ্নের মতো লাগছে। ইব্রাহিমের জন্য গাওয়া আমার কাছে বিশেষ একটি অভিজ্ঞতা।’ ২০২৪ সালে মাহি তাঁর প্রথম গান ‘সরি’ প্রকাশ করেন। এরপর ‘জাদুগরি’ নামে দ্বিতীয় গানটি প্রযোজনা করেন তাঁর বড় ভাই সোহম মুখার্জি। ২০২৪ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে মাহির পারফরম্যান্সও আলোচনার জন্ম দেয়। নিয়মিত কনসার্টে গান গেয়ে মুগ্ধ করছেন শ্রোতাদের।
বাবার সময়ের গানের সঙ্গে এখনকার গানের পার্থক্য
সংগীতজগতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে পরিবর্তন এসেছে, সেটা নিয়েও কথা বলেন মাহি। তাঁর মতে, এখন গান তৈরিতে মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে পরিমাণ, গানের গভীরতা বা বিষয়বস্তু নয়।

তাঁর ভাষ্যে, ‘আমার মনে হয়, এখন বিষয়বস্তুর চেয়ে সংখ্যার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগে একটা গান রিলিজ করাটাই ছিল অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সিরিজে গান তোলা, দোকানে পৌঁছানো, চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া—এই সবকিছুই ছিল বড় জটিল প্রক্রিয়া। আজকাল সংগীতে প্রবেশের বাধা অনেকটাই কমে গেছে। সংগীতশিল্পের পরিধি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখন তো মানুষ ফোনেই গান বানিয়ে ফেলছেন। যেহেতু স্মার্টফোন সবার হাতে পৌঁছে গেছে, তাই এখন যে কেউ গান বানাতে পারেন। আপনার গলার সুর ভালো থাকলে তো কথাই নেই। কণ্ঠ ভালো না হলেও উপায় আছে। আমি মনে করি, এটিই সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। এখন অনেক বেশি মানুষ গান গাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পীর সংখ্যা বেড়েছে। একজন শিল্পী হিসেবে এটি অত্যন্ত আশাজাগানিয়া।’
বাবার যে উপদেশ মেনে চলেন
বাবার কাছ থেকে পাওয়া উপদেশের কথা জিজ্ঞেস করলে মাহি বলেন, তিনি বাবার কাছ থেকে যে উপদেশটা পেয়েছেন, তা শুধু সংগীতের ক্ষেত্রে নয়, তাঁর জীবনেও অবদান রেখেছে। ‘বাবা আমাকে বলেছিলেন, “ছোট হোক বা বড়—যেকোনো কাজেই শতভাগ দিতে হবে। এই সিনেমা তো বড় না, ২-৩ দিনেই শুট করে ফেলি বা এই শোতে তো বেশি লোকজন নেই, এত কষ্ট করার কী দরকার—এই চিন্তা করলে চলবে না। দুজন লোকের সামনে পারফর্ম করলেও যেভাবে দেবে, ২০ হাজার লোকের সামনেও সেই রকম দিতে হবে।” বাবার এই কথা আমি সব সময় মাথায় রাখি,’ বলেন তিনি। মাহি মনে করেন, তিনি ২০ হাজার লোকের সামনে পারফর্ম করার মতো এত বড় শিল্পী হয়ে ওঠেননি; কিন্তু একদিন সেখানে পৌঁছাতে চান। এ জন্য যে তাঁকে এখন থেকেই নিজের ২০০ শতাংশ দিতে হবে, সেটাও ভালো করে জানান। এ জন্যই তিনি দুজন শ্রোতার সামনেও একই রকম নিবেদন নিয়ে হাজির হন।
এভাবেই বাবার ছায়াতলে থেকেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পথে এগিয়ে চলেছেন মাহি। যদিও তিনি নতুন প্রজন্মের জন্য গান গান, কিন্তু হৃদয়ে ধারণ করেন সংগীতের চিরায়ত সাধনার ধারাকে।

পৃথা পারমিতা নাগ
ঢাকা