ফিলিস্তিনের নাকবা, ইসরায়েলের ৭৫ বছর

0
184
১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ হাইফা বন্দরে ভিড়ছে জাহাজ ‘এক্সোডাস’, এই জাহাজে ইউরোপ থেকে আসে অবৈধ ইহুদি অভিবাসীরা

ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের চূড়ান্ত দখলদারত্বের সূচনার মাধ্যমে আজ থেকে ৭৫ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর অনিঃশেষ এক বিপর্যয় নেমে আসে। আরবিতে বিপর্যয়কে বলা হয় ‘নাকবা’।

প্রতিশ্রুত ভূমি।’ ‘মনোনীত সম্প্রদায়।’ ‘ভূমিহীন মানুষের জন্য মনুষ্যহীন ভূমি।’ পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত অত্যন্ত শক্তিশালী তিনটি বয়ান, যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ইহুদিদের জন্য ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে জোরপূর্বক আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেল বা তানাখ অনুসারে নবী আব্রাহামকে ঈশ্বর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশধরদের জন্য একটি ভূখণ্ড নির্দিষ্ট করা হয়েছে, যা বংশপরম্পরায় তাদের পুণ্যভূমি হিসেবেই থাকবে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে আজ যেখানে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল, সেটি হলো সেই ভূমি, যদিও বাইবেলের আরেক বিবরণ অনুসারে এটি মিসর থেকে ইউফ্রেতিস নদীর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত। আবার যাদের জন্য ঈশ্বর এই ভূমির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা হলো ইহুদি সম্প্রদায়, যারা এই বাইবেল অনুসারেই, মহাপ্রভুর মনোনীত সম্প্রদায় বা জাতি (চুজেন পিপল)। ঈশ্বরের সঙ্গে ইহুদিদের রয়েছে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক, একমাত্র তাদের সৌভাগ্য হয়েছে ঈশ্বরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার। সে কারণেই তারা জগতের শ্রেষ্ঠতম জাতি, যারা সব অ-ইহুদিকে নিম্ন জাতের বলে মনে করে।

যেহেতু ইহুদি শুধু একটি ধর্মাদর্শই নয়, একই সঙ্গে একটি সম্প্রদায় বা জাতি, তাই অন্য ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে ব্যতিক্রম। ইহুদিরা একই সঙ্গে ধর্ম, নৃতত্ত্ব ও সংস্কৃতি দ্বারা একসূত্রে গাঁথা। যদিও ইহুদিদের মতো খ্রিষ্টান ও মুসলমানরাও একেশ্বরবাদী ইব্রাহিমীয় ধর্মাদর্শের অনুসারী। অর্থাৎ বিশ্বের এই তিনটি প্রধান ধর্মের আদি পিতা একজনই—আব্রাহাম {বা পবিত্র কোরআন মতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)}।

ফিলিস্তিনিরা প্রতিবছর তাই ১৫ মে তারিখটিকে ‘আল-নাকবা’ দিবস হিসেবে পালন করে। আর এ বছরই প্রথম জাতিসংঘে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হচ্ছে।

ইহুদিরা হিব্রু সম্প্রদায় হিসেবেও পরিচিত, যেহেতু তাদের ভাষাও হিব্রু। ঈশ্বরের পছন্দের জাতি বা সম্প্রদায়ের মানুষেরা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমিতেই বসবাস করবে। তারা সেটা করেও আসছিল মুসা (আ.) তাদের মিসর থেকে সিনাই উপত্যকা হয়ে কেনানে ফিরিয়ে আনার পর থেকে (খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ১৪০০ সাল)। তবে দুই হাজার বছরের বেশি আগে (৭০ খ্রিষ্টাব্দে) রোমানরা জেরুজালেমে ইহুদিদের দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস করে তাদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়।

হিব্রুরা স্বভূমি থেকে উৎখাত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে। নির্বাসিত হয়েও তাদের মন পড়ে থাকে সেই প্রাচীন ভূমিতে, যেখানে রয়েছে জেরুজালেম ও ইহুদিদের দ্বিতীয় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, আছে প্রাচীন জুদিয়া ও সামারিয়া, আছে জায়ন পাহাড়। তারা অবশ্য এটাও বিশ্বাস করত যে একসময় এই প্রতিশ্রুত ভূমিতে তারা বা তাদের উত্তরসূরিরা ফিরে আসবে। সুতরাং আজকে যে ইহুদিরা ইসরায়েলে বসবাস করছে, তারা দুই হাজার বছর আগে এই ভূমি থেকে বিতাড়িত হিব্রু সম্প্রদায়েরই বংশধর।

স্বভূমি থেকে উৎখাত ও দুই হাজার বছর পর স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে এই ভূমিতে ফিরে আসার মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময়ে তাহলে কারা ছিল এই ভূমিতে? নাকি এই ভূমি ছিল মানববসতিহীন? এর উত্তর দেওয়া হয়েছে এভাবে: যারা পরবর্তী সময়ে থেকেছে, তারা আসলে সেই ভূমির মানুষ নয়, এমনকি কোনো মানবসম্প্রদায়ও নয়! আর তাই সেই ভূমি হলো মনুষ্যহীন ভূমি। এই বয়ান প্রতিষ্ঠা করতেই বলা হলো, ফিলিস্তিনি বলে কিছু নেই, ফিলিস্তিনি জনগণ বা সম্প্রদায় বলে কিছু নেই। বরং সেই মনুষ্যহীন ভূমির প্রকৃত দাবিদার হলো হিব্রু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সুতরাং তারা যখন আবার এসে এখানে বসবাস শুরু করেছে, তখনই এই ভূমি সঠিক মালিকের কাছে ফিরে গেছে। তার আগপর্যন্ত যারা থেকেছে এবং তা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বংশপরম্পরায় তারা, মানে ফিলিস্তিনিরা, বিশেষত মুসলমানরা উৎখাতযোগ্য এবং যথাযথভাবেই তা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

১৯৪৮ সালে জায়নবাদীদের হামলার পর একদল ফিলিস্তিনি গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে
১৯৪৮ সালে জায়নবাদীদের হামলার পর একদল ফিলিস্তিনি গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে

ইহুদিদের চূড়ান্ত দখলদারত্ব সূচনার মাধ্যমে আজ থেকে ৭৫ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর অনিঃশেষ এক বিপর্যয় নেমে আসে। সেটা ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। ফিলিস্তিনের ভূমিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পরপরই সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত ও রাষ্ট্রহীন হওয়ার বিপর্যয় শুরু হয়। আরবিতে বিপর্যয়কে বলা হয় ‘নাকবা’। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবছর তাই ১৫ মে তারিখটিকে ‘আল-নাকবা’ দিবস হিসেবে পালন করে। আর এ বছরই প্রথম জাতিসংঘে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি জনগণের অবিসংবাদিত অধিকার আদায়বিষয়ক জাতিসংঘ কমিটি (ইউএনসিআইআরপিপি) নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে দিনব্যাপী নানা আয়োজনে নাকবা দিবস পালনের জন্য ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদ অনুমোদন দেয়।

অবশ্য ফিলিস্তিনিরা ৭৫ বছর ধরে এই নাকবা দিবস পালন করছে না। বরং ১৯৯৮ সালে ইসরায়েল যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ঘটা করে উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নেয়, তখন ফিলিস্তিনিদের কিংবদন্তি নেতা ও ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁরাও তাঁদের নাকবার ৫০ বছর পূর্তি পালন করবেন। তিনি ইসরায়েলের স্বাধীনতা দিবসের পরের দিনটিকে নাকবা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা জেরুজালেম কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটা নির্ধারণ
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা জেরুজালেম কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটা নির্ধারণ

প্রথমবার নাকবা দিবস পালনের আগের দিন সন্ধ্যায় ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছিলেন যে ফিলিস্তিনিদের ট্র্যাজেডির জন্য ইসরায়েল দায়ী নয়; বরং দায়ী তাদের নেতৃত্ব। তবে ফিলিস্তিনিদের জন্য কী পরিহাস যে সিকি শতাব্দী পরে নাকবা দিবস পালনের সময় সেই নেতানিয়াহুই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, যাকে ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎস বিভিন্ন সময় বর্ণবাদী ও জাতিবিদ্বেষী হিসেবে অভিহিত করেছে।

ফিলিস্তিনের নাকবা মানে ইসরায়েলের স্বাধীনতা। আর ইসরায়েলিরা প্রতিবছর হিব্রু অষ্টম মাস আইয়ারের পাঁচ তারিখে দিবসটি উদ্‌যাপন করে, যাকে হিব্রুতে বলে ইয়োম হা-য়াতযামুত। হিজরির মতো অনেকটা চন্দ্রভিত্তিক হওয়ায় প্রতিবছর গ্রেগরীয় বা আন্তর্জাতিক বর্ষপঞ্জির ১৪ মে তারিখের সঙ্গে কখনো মিল আর কখনো আগে-পরে গিয়ে অমিল হয়।

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গভীর রাতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ৯ মে, ২০২৩
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গভীর রাতে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ৯ মে, ২০২৩ছবি: রয়টার্স

জায়নবাদ থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র

অস্ট্রিয়ার ইহুদি সাংবাদিক, নাট্যকার ও রাজনীতিক থিওডর হারজেলের উদ্যোগে ১৮৯৭ সালের আগস্ট মাসে সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল নগরে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব জায়নবাদী সম্মেলন (ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট কংগ্রেস)। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে শুধু ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা গৃহীত হয়। প্রসঙ্গত, ১৮৯৫ সালে অস্ট্রীয় লেখক নাথান বারনবুম ‘জায়নইজম’ বা জায়নবাদ শব্দটি প্রবর্তন করেন।

মোটাদাগে এই মতবাদ হলো ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার এবং সেই ভূমির ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার জাতীয় আন্দোলন। যেহেতু ইহুদি হওয়ার কারণেই বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে অন্য জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও ধর্মের মানুষ দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা, সেহেতু একটি পর্যায়ে তারা উপলব্ধি করে যে একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি তথা দেশ না হলে তাদের ওপর এই নির্যাতন বন্ধ হবে না। জায়নবাদী আন্দোলন এ থেকেই উৎসারিত। আর জায়নবাদীরা ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ভূমিতেই ইহুদিদের নিজস্ব দেশ গঠনের কোনো বিকল্প নেই বলে দাবি তোলে। শুরু হয় নানামুখী তৎপরতা।

১৯৪৮
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় বেন গুরিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে তেল আবিবে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সঙ্গে সঙ্গে একে স্বীকৃতি দেন। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর অনিঃশেষ এক বিপর্যয় নেমে আসে

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে নিতে ১৯২০ সালে ইতালির সান রেমো শহরে গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী এবং জাপান, বেলজিয়াম ও গ্রিস সরকারের প্রতিনিধিরা একত্র হন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে সিরিয়া ফরাসি ম্যান্ডেটে আর ফিলিস্তিন ও মেসোপটেমিয়া বা ইরাক ব্রিটেনের ম্যান্ডেটে শাসিত হবে। ১৯২২ সালে লিগ অব নেশনসের মাধ্যমে এই ম্যান্ডেট অনুমোদন করা হয়। এদিকে ১৯২৩ সালে তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানীয় খেলাফত বা সালতানাত অবলুপ্ত হয়ে যায় কামাল আতার্তুকের হাত দিয়ে।

ফিলিস্তিনকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে নেওয়ার পেছনে ছিল এক সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর জায়নবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে ৬৭ শব্দের এক পত্রে জানান, ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার জন্য যা করা প্রয়োজন, তার সবই করবে। এটি ‘বেলফোর ঘোষণা’ হিসেবে পরিচিত, যাকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম বড় নিয়ামক হিসেবে দেখা হয়।

সান রেমো সম্মেলনে বেলফোর ঘোষণা কার্যকর করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হলো ব্রিটিশ সরকারকে। সেটাকে অন্য মিত্রশক্তিগুলো সমর্থন দিল। এর পর থেকে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইউরোপ থেকে ইহুদিরা দলে দলে পাড়ি জমাতে থাকে। তারা সেখানে জমিজমাও কিনতে থাকে। প্রথম দিকে ফিলিস্তিনিরা এটায় গুরুত্ব দেয়নি। তা ছাড়া তখনো সেখানে মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদি ও খ্রিষ্টানদেরও বসবাস ছিল।

এই তিন ধর্মের মানুষ হাজার বছরের বেশি সময় ধরেই এই ভূমিতে বসবাস করে আসছিল। এই ইহুদিরা ছিল বেশির ভাগই প্রাচ্যের ইহুদি, যারা মিজরাহি হিসেবে পরিচিত। আর ইউরোপ থেকে আসতে থাকে আশকেনাজি ইহুদিরা, যারা আবার ইহুদিদের মধ্যে নিজেদের সবচেয়ে উচ্চবর্ণের বলে দাবি করে থাকে। ১৮৮২ ও ১৯০৪ সালে রাশিয়া ও ইউরোপ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ইহুদির অভিবাসন ঘটে ওসমানীয় ফিলিস্তিনে। অভিবাসী ইহুদিরা স্থানীয় আরবদের জমিজমা কিনতে থাকে। আরবরা বেশির ভাগই ছিল মুসলমান।

ফিলিস্তিনি গেরিলাদের নেতা ইয়াসির আরাফাত। পরে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি
ফিলিস্তিনি গেরিলাদের নেতা ইয়াসির আরাফাত। পরে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনিফাইল

ইউরোপীয় ইহুদিদের স্রোত বাড়তে থাকায় একপর্যায়ে স্থানীয় ফিলিস্তিনি-আরবদের সঙ্গে তাদের বৈরিতা-সংঘাত দেখা দেয়। ১৯৩৩ সালে ফিলিস্তিনিরা বড় আকারে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু করলে ব্রিটিশ সরকার কঠোরভাবে তা দমন করে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনে স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের নানামুখী পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড চলতেই থাকে।

তারই অংশ হিসেবে ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত পিল কমিশন ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করে ৭৫ শতাংশ আরব ও বাকিটা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সুপারিশ করে। তবে তিন ধর্মের পবিত্র স্থান জেরুজালেমকে জাফাসহ ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাখার কথাও বলা হয়। আরব ও ইহুদি—দুই পক্ষই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

কিন্তু ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। ছয় বছরব্যাপী এই যুদ্ধ চলাকালে জার্মান নেতা হিটলারের নেতৃত্বে ইউরোপে ইহুদি নিধনযজ্ঞ (হলোকাস্ট) সারা দুনিয়ায় বিভীষিকা তৈরি করে। কমবেশি ৬০ লাখ ইহুদি নাৎসি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। প্রাণ বাঁচাতে সে সময় অনেক ইহুদি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে থাকে, অনেকে আসে ফিলিস্তিনে, যদিও ব্রিটিশ সরকার ইহুদি অভিবাসন সীমিত করে দিয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে জায়নবাদী সম্মেলনে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা গৃহীত হয়।

প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ডি নামে এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন। প্ল্যান ডি ছিল হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা

১৯৪৫ সালে জার্মানি-জাপান অক্ষশক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ইউরোপ ইহুদি নিধনের বিভীষিকার তরতাজা স্মৃতি সারা বিশ্বের সমবেদনা কেড়ে নেয়। ফলে ইহুদিদের রাষ্ট্র স্থাপনের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে শাসিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৫৬ শতাংশ ইহুদি ও ৪৩ শতাংশ ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় ৩৩-১৩ ভোটে (চীনসহ ১০ দেশ ভোটদানে বিরত ও থাইল্যান্ড অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিল)। এতে জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নগরের মর্যাদা দেওয়া হয়। ইহুদিরা এটা মেনে নিলেও আরবরা এতে আপত্তি জানায়। আরব লিগ নেতৃত্ব প্রশ্ন তোলেন, হলোকাস্টের অপরাধের শাস্তি কেন আরবদের পেতে হবে?
এদিকে জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়ার ছক কেটে ফেলে। প্ল্যান দালেত বা প্ল্যান ডি নামে এই পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন। প্ল্যান ডি ছিল হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের নিজ ভূমি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা। ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে হাগানাহ, স্টার্ন গ্যাংসহ ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তা বাস্তবায়নে পুরোদমে নেমে যায়। স্থানীয় আরবরা ইহুদিদের হামলা ও হত্যার শিকার হতে থাকে। ফলে নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিঃস্ব অবস্থায় লাখ লাখ ফিলিস্তিনি প্রাণ রক্ষায় ছুটে পালাতে থাকে। মূলত মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত সাত লাখ ফিলিস্তিনি আশপাশের আরব দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। কিছু কিছু স্থানে ইহুদিরাও আক্রান্ত হয় ও মারা পড়ে।

ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, তারা ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের (পিআইজে) আস্তানা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ৯ মে ২০২৩
ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, তারা ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের (পিআইজে) আস্তানা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ৯ মে ২০২৩

১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট বা শাসন শেষ হলে বেন গুরিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান সঙ্গে সঙ্গে একে স্বীকৃতি দেন। আনুষ্ঠানিকভাবে আল–নাকবা বা মহাবিপর্যয় নেমে আসে ফিলিস্তিনিদের ওপর।

আরব দেশগুলোর ব্যর্থতা

ফিলিস্তিনিদের এই মহাবিপর্যয় সৃষ্টির জন্য আরব দেশগুলোর দুর্বলতা ও ব্যর্থতাও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। অথচ আরব ও মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত ফিলিস্তিনের ইতিহাসে আরব দেশগুলোর অবস্থান নির্মোহভাবে তুলে ধরা হয়নি। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে আরব লিগের সদস্য মিসর, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ও ইরাকের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এবং সদ্য ঘোষিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রথম দিকে আরবরা কিছুটা সুবিধা করতে পারলেও দ্রুতই তারা পিছু হটতে থাকে। সামরিক শক্তির দিক থেকে আরব দেশগুলো ছিল দুর্বল, যদিও সংখ্যায় প্রথম দিকে তারা ছিল বেশি। তবে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়া ও রক্ষার প্রত্যয়ে প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত ইহুদি যোদ্ধাদের সামনে তারা ছিল দিগ্‌ভ্রান্ত ও লক্ষ্যহীন। তদুপরি নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। ফলে ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে আরব দেশগুলো যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

১৯৪৭
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে শাসিত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ৫৬ শতাংশ ইহুদি ও ৪৩ শতাংশ ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার পরিকল্পনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়

জর্ডানের বাদশাহ প্রথম আবদুল্লাহ আগ্রহী ছিলেন ফিলিস্তিনের ভূমিকে সংযুক্ত করে নিয়ে বৃহত্তর হাশেমীয় সিরিয়া গঠনের। সিরিয়াবাসী ইসরায়েলের চেয়ে জর্ডান নিয়ে বেশি ভীত থাকায় তাদের সেনারা ফিলিস্তিনে হাজির হয়েছিল মূলত পশ্চিম তীর জর্ডানের দখলে যাওয়া থেকে রুখতে। মিসরও হাশেমীয় জর্ডানের পরিকল্পনা ঠেকাতে চেয়েছিল। ফলে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন হয়ে ওঠে এসব আরব দেশের উচ্চাভিলাষ ও ভীতির এক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা ও ভবিষ্যতের চিন্তা আসলে পেছনে পড়ে যায়।

১৯৪৭ সালেই জায়নবাদী নেতা গোল্ডা মেয়ার (ইসরায়েলের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী ও এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী) গোপনে ট্রান্সজর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এতে বাদশাহ পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীর পাওয়ার বিনিময়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত হন। প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে জর্ডান তাই পশ্চিম তীর দখলে নিতে সক্ষম হয়। ওদিকে মিসর দখল করে নেয় গাজা উপত্যকা। তবে দুই দশকের মধ্যেই ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে গাজা ও পশ্চিম তীর যথাক্রমে মিসর ও জর্ডানের হাতছাড়া হয়ে যায়।

ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের একাংশ। উচ্চ প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে নেতৃস্থানীয় দেশ ইসরায়েলে প্রতি ১০ হাজারে ১৩৫ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী
ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের একাংশ। উচ্চ প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে নেতৃস্থানীয় দেশ ইসরায়েলে প্রতি ১০ হাজারে ১৩৫ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী

ইসরায়েলের এগিয়ে যাওয়া

গত ৭৫ বছরে চারটি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রতিটিতে আরবরা পরাজিত হয়েছে আর ফিলিস্তিনিরা নিজ ভূমে ক্রমে কোণঠাসা হয়েছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল সাড়ে সাত দশক ধরে বিকশিত হয়ে চলেছে। দেশটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক শক্তি, যার আছে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার, আছে বিশ্বের দুর্ধর্ষতম গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।

উচ্চ প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে নেতৃস্থানীয় দেশটির প্রতি ১০ হাজারে ১৩৫ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী। এটি পরিণত হয়েছে ‘স্টার্টআপ নেশনে’। নিপুণভাবে পানি ছিটানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে সেই ’৫০-এর দশকে। ঊষর মরুর বুকে ব্যাপক সবুজায়ন ঘটিয়েছে। অধিবাসীদের গড় আয়ু বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। ইসরায়েলের অর্জন আধুনিক বিশ্বের এক বিরাট বিস্ময় বললেও অত্যুক্তি হয় না, যার পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের অকুণ্ঠ সমর্থনও ভূমিকা রেখেছে।

একই সঙ্গে এই সমর্থনের জোরে, বিশেষত যুগের পর যুগ যুক্তরাষ্ট্রের একচোখা মদদে ফিলিস্তিনিদের ভূমি-পানি-গাছপালা-ঘরবাড়ি—সবই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। ফিলিস্তিনিদের একাংশ জর্ডান সীমান্তঘেঁষা পশ্চিম তীরে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত, আরেকাংশ মিসরের সিনাই সীমান্তঘেঁষা গাজায় ইসরায়েল আরোপিত অবরোধের মধ্যে জীবন যাপন করছে। ফিলিস্তিনিরা নিয়মিতই ইসরায়েলি হামলা-নির্যাতন-হত্যা-দখলদারির শিকার হচ্ছে। ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক নেতৃত্বও একাধারে দ্বিধাবিভক্ত, দিশাহীন ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছেন। আরব দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থবহ ও কার্যকর সহযোগিতা অতীতেও মেলেনি, আজও মিলছে না। ফিলিস্তিনিরা টিকে আছে নিজস্ব প্রতিরোধ-সংগ্রাম আর কিছু সীমিত বৈশ্বিক সহায়তায়। শেষ হচ্ছে না তাদের নাকবার।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.