নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার সস্তাপুরে রোববার দিবাগত রাত ১২টার দিকে একটি ডাইং কারখানায় আগুন লাগে। সেখানে আগুন নেভানোর কাজ শেষে গভীর রাতে স্টেশন ফিরে বুকে ব্যথা অনুভব করছিলেন ফায়ার সার্ভিসের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর হোসেন। সোমবার সকালে বিষয়টি মুঠোফোনে স্ত্রী রেখা বেগমকে জানিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। তখন তিনি ঢাকায় ভালো চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন।
এর মধ্যে সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সদর উপজেলার পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীতে ফকির অ্যাপারেলসের ডাইং বিভাগে ওয়াশিং মেশিনে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে হাজীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দেন জাহাঙ্গীর। বেলা ১১টার দিকে শহরের চাষাঢ়ায় গাড়িটির চালক জাহাঙ্গীর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এ সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রাইভেট কার, ব্যাটারিচালিত তিনটি অটোরিকশা এবং যাত্রীবাহী একটি বাসকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলে আনন্দ পরিবহনের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন শাহাবুদ্দিন শাবু (৪৫) নামের এক পথচারী ও সিরাজুল ইসলাম নামের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক। মারা যান জাহাঙ্গীর হোসেনও। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেনের ধারণা, জাহাঙ্গীর স্ট্রোক করে মারা গেছেন।
স্বামী জাহাঙ্গীর হোসেনের মৃত্যুর খবর পেয়ে সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে কুমিল্লা থেকে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ছুটে আসেন তাঁর স্ত্রী রেখা বেগম ও বড় মেয়ে চাঁদনী ও ছোট ছেলে আরাফাত। চাঁদনী এবার উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী, সাত বছরের ছোট ছেলে আরাফাত মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। মেজ মেয়ে ঝুমু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। হাসপাতালের মর্গে জাহাঙ্গীরের মরদেহ দেখে স্ত্রী ও সন্তানেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
রেখা বেগম বলেন, ঘটনার ৩০ মিনিট আগে স্বামী জাহাঙ্গীরের সঙ্গে মুঠোফোনে তাঁর কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আগের রাতে আগুন নেভাতে গিয়ে গভীর রাতে ফিরতে হয়েছে। এর পর থেকে তাঁর বুকটা ব্যথা করছে, অসুস্থবোধ করছিলেন। তিনি (জাহাঙ্গীর) বলেছিলেন, তাঁরা দুজন একসঙ্গে ঢাকায় ভালো ডাক্তার দেখাবেন। প্রায় ১০ মিনিট কথা বলার পর ডিউটিতে যাচ্ছেন বলে ফোন রেখে দেন জাহাঙ্গীর।
রেখা বেগম বলেন, কিছুক্ষণ পর ফায়ার সার্ভিস অফিস থেকে তাঁকে ফোন দিয়ে জানানো হয়, তাঁর স্বামী জাহাঙ্গীর স্ট্রোক করেছেন, তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের দ্রুত নারায়ণগঞ্জ আসতে বলা হয়। খবর পেয়ে তিনি কুমিল্লা থেকে নারায়ণগঞ্জে ছুটে আসেন। রেখা বেগম জানান, তাঁর স্বামীর আয়ের ওপর তাঁদের সংসার চলত।
এখন স্বামী নেই, সংসার চলবে কীভাবে? ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা চলবে কীভাবে?
চাষাঢ়ায় দুর্ঘটনার সময় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে চালক জাহাঙ্গীরের বাঁ পাশে বসা ছিলেন হাজীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা ওবায়দুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁদের গাড়িটি চাষাঢ়া মোড়ে যানজটে পড়ে। তাঁদের গাড়ির সাইরেন শুনে ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল ছেড়ে দিলে জাহাঙ্গীর গাড়িটি প্রথম গিয়ারে টান দেওয়ামাত্র তিনি স্টিয়ারিংয়ের ওপর ঢলে পড়েন। তিনি ডাকলেও জাহাঙ্গীর কোনো সাড়া দেননি।
ওবায়দুল বলেন, ‘প্রথমে আমি গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ১০ সেকেন্ডের মধ্যে গাড়িটি সামনে থাকা অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও ট্রাকে ধাক্কা দেয়। পরে গাড়ি থামিয়ে নেমে আশপাশের লোকজনের সহায়তায় আমাদের গাড়ির নিচ থেকে দুজনকে উদ্ধার করি। এ সময় গাড়ির চাপায় কয়েকটি অটোরিকশা দুমড়েমুচড়ে যায় এবং বাসের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারী ধাক্কা লেগে চাকার নিচে চলে যান।’
বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত জাহাঙ্গীর হোসেনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন বলেন, ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছিল জাহাঙ্গীরের। ভিসেরা প্রতিবেদনের নমুনা ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়া গেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির ধাক্কায় আহত হন রিকশাচালক মাসুম মিয়া। এ সময় তাঁর রিকশায় এক শিশুসহ এক নারী যাত্রী ছিলেন। তাঁরাও আহত হন। মাসুম মিয়া জানান, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটি পঞ্চবটীর দিকে যাচ্ছিল। এ সময় হঠাৎ গাড়িটি দ্রুতগতিতে রিকশাসহ আরও কিছু গাড়িকে ধাক্কা দেয়। তিনিসহ রিকশার যাত্রীরা গুরুতর আহত হন। রিকশাযাত্রী শিশু ও নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটি দ্রুতগতিতে একসঙ্গে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, মিনিট্রাক ও একটি যাত্রীবাহী বাসকে ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনার পর অটোরিকশাগুলো দুমড়েমুচড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাসের ধাক্কায় পথচারী একটি তৈরি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে আটকে যান। পরে বাসের লোহার প্লেট কেটে তাঁর মরদেহ বের করা হয়।