শেষবার টেমসের পাড়ে লন্ডনে বসেছিল বিশ্বকাপ। সেখান থেকে সবরমতীর ধারে গান্ধীর শহরে শুরু হচ্ছে এবারের আসর। এমনিতে গান্ধীর এই শহর শান্ত ও কোলাহলমুক্ত থাকতেই ভালোবাসে। কিন্তু ক্রিকেটের মহোৎসবে আহমেদাবাদ বরাবরের মতো ক্রিকেটীয় কলরবে মজবে। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে খেলা আজ।
নথিপত্র বলে, এই মাঠে ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শক একসঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারেন। ১ লাখ ৫০ হাজার আসনের উত্তর কোরিয়ার রুংরাডা মে ডে স্টেডিয়ামের পরই তালিকায় মোদির মাঠ। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সুবর্ণজয়ন্তীতে সবকিছুতে যে বৃহৎ একটা ব্যাপার থাকবে, তা আগে থেকেই ইঙ্গিত দিয়েছিল আইসিসি।
যদিও বাড়ির পাশের এই বিশ্বকাপ উৎসবে বাংলাদেশ নামছে এক দিন পর। ধর্মশালায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে শনিবার প্রথম ম্যাচ সাকিবদের। আনন্দ আয়োজনে সেদিনই লাগবে লাল-সবুজের রং। তা ছাড়া লম্বা সময়ের এই ক্রিকেটযজ্ঞ। ভারতের ১০টি শহর ঘুরে ৪৬ দিনে ৪৮টি ম্যাচ। ক্রিকেটারদের মতো সমর্থকদেরও কিছুটা দম ধরে রাখতে হবে বৈকি। ১৯৭৫ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর এবারই প্রথমবারের মতো এককভাবে বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছে ভারত। এর আগে ১৯৮৭ সালে প্রথমবার যখন উপমহাদেশে বিশ্বকাপের আয়োজন করা হয়েছিল, সেবার ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে পাকিস্তানের নামও ছিল। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। সর্বশেষ যেবার এ অঞ্চলে বিশ্বকাপের ম্যাচ মাঠে গড়িয়েছিল, সেবার ভারত আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশও ছিল। ১২ বছর পর ফের উপমহাদেশে ক্রিকেটের মহোৎসবে এবার এককভাবে আয়োজনের সব ভার পড়শি ভারতের। রানীর দেশ থেকে ৪৮ বছর আগে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ অনেক ইতিহাস আর রোমাঞ্চের সাক্ষী নিয়ে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে এবার। ক্রিকেটের এই বৈশ্বিক আসরে শুরুর দিকে ক্যারিবীয়দের আধিপত্য দেখেছে সবাই। ১৯৭৫ আর ১৯৭৯– ক্লাইভ লয়েডরাই জিতে নিয়েছিল শিরোপা। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস! আজ সেই আসরেই নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বই পেরোতে পারেনি তারা। ড্যারেন সামির মতো সাবেকরা এ জন্য ওয়ানডের প্রতি নিজেদের অবহেলাকেই দায়ী করেছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি টি২০-এর করপোরেট বাজারে নিজেদের গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যই নাকি ‘ক্রিকেট ঈশ্বর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অভিশাপ দিয়েছে’।
বিশ্বকাপে ক্যারিবীয় রাজত্ব পতনের পর একসময় তা চলে যায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে। ১৯৮৭, ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ এবং সর্বশেষ ২০১৫– সবার চেয়ে বেশি পাঁচবার তারা বিশ্বকাপ জিতে নেয়। মাঝে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জিতে কপিল দেবের ভারত চমকে দেয় সবাইকে। ইমরান খানের পাকিস্তান ১৯৯২ বিশ্বকাপ জিতে নিজেদের ইতিহাস সমৃদ্ধ করে। রানাতুঙ্গাদের ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে রীতিমতো বিপ্লব এনে দেয়। ২০১১ বিশ্বকাপ জয় শচীনকে অমরত্ব এনে দেয়। ঠিক একইভাবে ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ও ইংল্যান্ডকে এনে দেয় ক্রিকেটে ইংলিশদের অবদানের স্বীকৃতি। তবে বিশ্বকাপের এই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট এখনও অধরা নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অবশ্যই বাংলাদেশের। এবারের সাকিব আল হাসানরা কি পারবেন ‘বিশ্বকাপের সেই কোহিনূর’ ভারত থেকে দেশে আনতে? স্বপ্নই তো বাঁচিয়ে রাখে সবাইকে। একদিন অবশ্যই বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতবে। কিন্তু সেই ‘একদিন’ কি এবারই আসবে? গেলবার থেকেই গ্রুপ পর্ব নয়, রাউন্ড রবিন লিগের খেলা হচ্ছে বিশ্বকাপে। তাই প্রতিটি দলের সঙ্গে একে অন্যের মুখোমুখি হতে হবে। বিশ্লেষকরা হিসাব করে দেখেছেন, সেমিফাইনাল খেলতে হলে অন্তত ছয়টি করে ম্যাচ জিততেই হবে। সেখানে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান এশিয়া কাপ থেকেই ঘোষণা দিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে অন্তত চারটি ম্যাচ তিনি জয়ের লক্ষ্য ধরে রেখেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বকাপের যে কোনো আসরেই বাংলাদেশ সর্বোচ্চ তিনটি করে ম্যাচ জিতেছে। সে হিসাবে সংখ্যাটা বাড়লেই যে খুশি হবেন সাকিব, সে কথা বলতে দ্বিধা করেননি তিনি।
এবারের আসরে আরও একটি ব্যাপার বেশ লক্ষণীয়। অংশগ্রহণকারী ১০ দলের ৯ দলেই নতুন অধিনায়ক। ২০১৯ সালে খেলা অধিনায়কদের মধ্যে কেবল নিউজিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামসনই রয়ে গেছেন। যদিও ইনজুরির কারণে হয়তো প্রথম ম্যাচ তিনি খেলতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে বিশ্বকাপে ১০ দলই প্রথম ম্যাচ খেলতে নামছে নতুন অধিনায়কের নেতৃত্বে। যদিও বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করাটা সাকিব আল হাসানের জন্য অন্তত নতুন কিছু না। ২০১১ সালে ঘরের মাঠে তিনিই লাল-সবুজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তবে এবার বিশ্বকাপের ১৩তম আসরে এসে বছর ছত্রিশের সাকিব নিজেকে অনেক বেশি পরিণত বলে মনে করছেন। অভিজ্ঞতার ঝুলিও তাঁর অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বিশ্বকাপে এ নিয়ে যখন সাতবারের মতো অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, সেখানে সাকিব খেলতে নামবেন তাঁর পঞ্চম বিশ্বকাপ। নিশ্চিতভাবে সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহর জন্যও এটি শেষ বিশ্বকাপ। তাই এ আসরে এমন কিছু তারা করে যেতে চাইবেন, যার জন্য দল তাদের আগামীতে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
বিশ্বকাপে কে ফেভারিট? তা নিয়ে এরই মধ্যে বিশ্লেষক-ধারাভাষ্যকাররা একেকজন একেক নাম বলছেন। সেমিফাইনালে কোন চার দল যাবে, তার নামও বলছেন। সেখানে সাধারণত তিনটি দলের নাম সবার মুখে মুখেই– ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। চতুর্থ দলটি হিসেবে কেউ পাকিস্তান, কেউ দক্ষিণ আফ্রিকা, কেউ নিউজিল্যান্ডের নাম বলছেন। সেখানে আতহার আলী খান বলছেন প্রিয় বাংলাদেশের কথা। এই আসরের প্রস্তুতি ম্যাচগুলো দেখে একটি ব্যাপার অন্তত স্পষ্ট হয়েছে আর তা হলো, প্রথমে ব্যাট করতে নামলে তিন শতাধিক রান করার মানসিকতা নিয়ে নামতে হবে এবং পরে ব্যাট করতে নামলেও তিন শতাধিক রান তাড়া করার মানসিকতা থাকতে হবে। কেননা, বিশ্বকাপের উৎসবে এই রানের ফুলঝুরিই দেখতে চান দর্শক, আর সেভাবেই আইসিসি পিচ তৈরিও করিয়েছে। বিশ্বকাপের সুবর্ণজয়ন্তীতে তাই সবর্ণ সুযোগই থাকছে ব্যাটারদের।
সঞ্জয় সাহা পিয়াল