প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠাৎ কেন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেন

0
22
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফাইল ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহান্তে যখন বি২ বোমারু বিমান পাঠিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালেন, তখন তিনি বাজি ধরেছিলেন, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে না জড়ানোর পুরোনো অঙ্গীকার বজায় রেখে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে তিনি মিত্র ইসরায়েলকে সাহায্য করতে চান।

বাংকার-বিধ্বংসী ওই বোমা হামলার ঠিক কয়েক দিন পর গতকাল সোমবার ট্রাম্প সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। তাঁর এই ঘোষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি হয়তো তেহরানের শাসকদের আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতেই বোমা নিক্ষেপ করেছেন।

কিন্তু বড় বড় অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। বিশেষ করে এই প্রশ্ন নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে, ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে আদৌ কোনো যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে কি না বা টিকবে কি না।

দুই শত্রু দেশের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে চলা ছায়াযুদ্ধ সম্প্রতি আকাশযুদ্ধে গড়িয়েছে। ১২ দিন ধরে দেশ দুটি একে অপরের ভূখণ্ডে পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও দুই পক্ষের মধ্যে কী শর্তে সমঝোতা হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান ব্যর্থ পারমাণবিক আলোচনা আবার শুরু করবে কি না কিংবা ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুতের ভবিষ্যৎ কী হবে—সেসব বিষয় উল্লেখ করেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে বিষয়টি এখনো অজানাই রয়ে গেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলা করলেও ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম নিরাপদে রয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা জনাথন প্যানিকফ বলেন, ইসরায়েল তাদের যুদ্ধ লক্ষ্যের অনেকটাই পূরণ করেছে। আর ইরান সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছিল।

দুই দেশ আসলে কী সমঝোতা করেছে, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। এরপরও ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা সংঘাতের অবসান নিয়ে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে।

জনাথন প্যানিকফ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশা করছে যে এটিই শেষের শুরু। তবে এরপর কী হবে, তা নিয়ে কোনো কৌশল আছে কি না—এটাই এখন চ্যালেঞ্জ।

দুই দেশ আসলে কী সমঝোতা করেছে, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। এরপরও ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা সংঘাতের অবসান নিয়ে কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত ইসরায়েলি স্থাপনা, ১৬ জুন
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত ইসরায়েলি স্থাপনা, ১৬ জুন, ছবি: রয়টার্স

ট্রাম্প বলেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর। উভয় দেশকে তা লঙ্ঘন না করার আহ্বান জানান তিনি। সর্বশেষ গতকাল তিনি তাঁর মালিকানাধীন সোশ্যাল ট্রুথে এক পোস্টে ইরানে হামলা না চালাতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এর আগে একজন ইরানি কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছিলেন, তেহরান যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। কিন্তু দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, ইসরায়েল হামলা না থামালে সংঘাত বন্ধ হবে না।

কিন্তু এ কথা ট্রাম্প ও তাঁর অনুগতদের আটকে রাখতে পারেনি। তাঁরা এটিকে এমন এক পররাষ্ট্রনীতির ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে প্রচার করছেন, যেটিকে তাঁরা শক্তির মাধ্যমে শান্তি বলে অভিহিত করেন।

ইসরায়েল লম্বা সময় ধরে বলে আসছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে আছে। যদিও তেহরান বরাবরের মতোই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বছরের শুরুতে বলেছিল, তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। আর মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সূত্র গত সপ্তাহে রয়টার্সকে জানিয়েছে, সেই মূল্যায়ন এখনো পরিবর্তন হয়নি।

ইরানের পরিমিত প্রতিক্রিয়া

ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগে ইরান কাতারে একটি মার্কিন বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

গত রোববার যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাংকার-বিধ্বংসী বোমা হামলা চালায়। জবাবে ইরান ওই মার্কিন বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়।

মার্কিন বিমানঘাঁটিতে ইরানের হামলার বিষয়ে অবগত কয়েকটি সূত্র জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা যাতে না বৃদ্ধি পায়, সে হিসাব করে গত সোমবার দিবাগত রাতে ইরান মার্কিন বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। এটি ছিল একটি পরিমিত পদক্ষেপ।

ইসরায়েল ও ইরানকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান ট্রাম্প। আর হোয়াইট হাউসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, যতক্ষণ না ইরান নতুন করে হামলা চালায়, ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল ইসরায়েল।

ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইরান ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা আর কোনো হামলা চালাবে না।

ইরানের হামলায় ধ্বংসস্তূপে রূপ নিয়েছে ইসরায়েলের তেল আবিবের ভবন। সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন দেশটির উদ্ধারকর্মী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ২২ জুন ২০২৫
ইরানের হামলায় ধ্বংসস্তূপে রূপ নিয়েছে ইসরায়েলের তেল আবিবের ভবন। সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন দেশটির উদ্ধারকর্মী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ২২ জুন ২০২৫,ছবি: রয়টার্স

ট্রাম্প সরাসরি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেছেন। আর মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ইরানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যোগাযোগ করেছেন বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

ইরানিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে কাতারও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছে।

হোয়াইট হাউসের ওই কর্মকর্তা বলেন, ইরান নিজেদের ‘দুর্বল অবস্থার’ কারণে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। কয়েক দিন ধরে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক হামলা হয়েছে। দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা করা হয়েছে।

ট্রাম্প সম্প্রতি প্রকাশ্যে ইরানের সরকার পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন।

সোমবার সকালে তিন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছিলেন, তাঁদের সরকার খুব শিগগির ইরানে চলমান অভিযানের ইতি টানতে চাইছে। তারা এই বার্তা যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিল। তবে বিষয়টি অনেকটাই তেহরানের ওপর নির্ভর করছে।

ওয়াশিংটনের জনস হপকিন্স স্কুল ফর অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ লরা ব্লুমেনফেল্ড বলেন, ট্রাম্প এখন ‘বিশ্বশান্তি’ ঘোষণা করেছেন। সুতরাং নেতানিয়াহুর জন্য এর বিরুদ্ধে যাওয়া কঠিন।

ট্রাম্পের বড় জুয়া

দীর্ঘদিন ধরে বড় কোনো বিদেশি যুদ্ধে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার করে আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সেই অঙ্গীকার ভুলে তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমা হামলার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

নিজের প্রেসিডেন্ট মেয়াদের সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে ট্রাম্প বাজি ধরেছিলেন, তিনি ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা ফর্দো ধ্বংস করতে পারবেন এবং এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নামমাত্র প্রতিশোধ নেবে ইরান।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বছরের শুরুতে বলেছিল, তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। আর মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সূত্র গত সপ্তাহে রয়টার্সকে জানিয়েছে, সেই মূল্যায়ন এখনো পরিবর্তন হয়নি।

আশঙ্কা ছিল, তেহরান প্রতিক্রিয়ায় হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। প্রণালিটি বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেল পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলার আশঙ্কা তো ছিলই। বিশ্বব্যাপী মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থের বিরুদ্ধে ইরানের মিত্র গোষ্ঠীগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল।

যদি ট্রাম্প ইসরায়েল-ইরান সংঘাত প্রশমিত করতে পারেন, তাহলে তিনি কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনার ঝড় কিছুটা শান্ত করতে পারবেন। এ ছাড়া নিজের দল রিপাবলিকানদের যুদ্ধবিরোধী অংশকেও সন্তুষ্ট রাখতে পারবেন, যারা তাঁর ইরানে বোমা হামলার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। এ ধরনের পদক্ষেপ ট্রাম্পের নির্বাচনী অঙ্গীকারের পরিপন্থী।

অন্যদিকে সংঘাত বন্ধ করতে পারলে ট্রাম্প তাঁর নীতিগত অগ্রাধিকারগুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে পারবেন। এসব অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো এবং বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে শুল্ক যুদ্ধের মতো বিষয়।

তবে ট্রাম্প ও তাঁর সহকারীরা ইরান এবং এ-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্নগুলো উপেক্ষা করতে পারবেন না।

এই যুদ্ধবিরতি কি টেকসই হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় প্রশাসনের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মধ্যস্থতাকারী ডেনিস রস বলেন, হ্যাঁ, ইরানিরা এখন যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন অনুভব করছে। আর ইসরায়েল তাদের সামরিক লক্ষ্যের বেশির ভাগই পূরণ করে ফেলেছে।

কিন্তু এখনো বাধা রয়ে গেছে। ডেনিস রস বলেন, ‘ইরান প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাদের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী? তাদের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুতের কী হবে? এগুলো নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হবে—আর সেগুলো সহজে সমাধানযোগ্য নয়।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.