শুটিং সেটে লাইট নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে সময় কাটত রবিনের। বিভিন্ন দৃশ্যে অভিনয়শিল্পীদের সামনে কখনো লাইট, কখনো ককশিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেই রবিনকে হয়তো আর কখনোই লাইট বা ককশিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে দেখা যাবে না। সহকর্মীরা তাঁকে আর বলবেন না, ‘ককশিটটা শক্ত করে ধর রবিন।’
রবিন শুটিংয়ে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। গত শুক্রবার আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জানান, রবিনের হাত কেটে ফেলতে হবে। আজ সোমবার বিকেলে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে এই লাইটম্যান সহকারীর খবর নিতে গেলে জানা যায়, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আজই তাঁর বাঁ হাতটি কেটে ফেলা হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তাঁর একটি পা–ও ঝুঁকিতে আছে। এ ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন রবিন। এখন কীভাবে চিকিৎসার খরচসহ পরিবার চালাবেন, সে চিন্তায় দিন কাটছে তাঁর। দুর্ঘটনা নিয়ে তিনি জানান, শুটিংয়ের জন্য আলাদা গাড়ি থাকলেও তাঁকে তাতে না পাঠিয়ে জেনারেটরের পিকআপে পাঠাতে বাধ্য করা হয়।
শুক্রবার আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জানান, রবিনের হাত কেটে ফেলতে হবে। সোমবার বিকেলে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আজই তাঁর বাঁ হাতটি কেটে ফেলা হয়েছে।
কী ঘটেছিল
শুক্রবার ইউটিউব চ্যানেল প্রাঙ্ক কিংয়ের একটি নাটকের শুটিংয়ে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে যাওয়ার সময় লাইট ও জেনারেটরবাহী একটি গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে পাঁচজন গুরুতর আহত হন। তাঁদের মধ্যে লাইট সহকারী রবিন, লাইট সহকারী শাহাদাত, হৃদয়, পিকআপ ড্রাইভার ইব্রাহীম, জেনারেটর অপারেটর আবদুর রাজ্জাকসহ আরও দুজন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন রবিন ও হৃদয়। রবিন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর হৃদয় জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে চিকিৎসাধীন। দুর্ঘটনায় তাঁর চোয়াল আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, পড়ে গেছে পাঁচটি দাঁত। বাকিরাও মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর মধ্যে আরও দুজন ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পিকআপে শুটিং ইউনিটের সদস্যদের পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সাতজনকে ঢাকা থেকে পাঠানো হয় জামালপুরে। যাওয়ার সময় রবিনসহ কয়েকজন অস্বীকৃতি জানালেও কানে নেননি কেউ।
দায় নিচ্ছেন না কেউ
পিকআপে শুটিং ইউনিটের সদস্যদের পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সাতজনকে ঢাকা থেকে পাঠানো হয় জামালপুরে। যাওয়ার সময় রবিনসহ কয়েকজন অস্বীকৃতি জানালেও কানে নেননি কেউ। ঢাকা থেকে ভোর চারটায় রওনা দিয়ে সাড়ে ছয়টার দিকে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার এলাকায় পৌঁছালে একটা লরিকে ধাক্কা দেয় পিকআপটি। এখন পর্যন্ত এ ঘটনার দায় নিতে চাচ্ছেন না কেউ। একপক্ষ দুষছে আরেক পক্ষকে।
প্রাঙ্ক কিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও নাট্যনির্মাতা আর্থিক সজীব দুর্ঘটনার দায় দিচ্ছেন লাইট হাউসকে। জানান, পুরো বিষয়টি লাইট হাউসের দেখভালের দায়িত্বে ছিল। সজীব বলেন, ‘ওদের জন্য বাসের টিকিট রাখা ছিল। কিন্তু জেনারেটর ওঠাতে দেরি হওয়ায় রাত ৮টার বাস মিস করেন তাঁরা। এরপর পিকআপে করে ইউনিটের কয়েকজন সদস্যকে নিতে হয়। এখানে লাইট হাউস থেকেই সব সমন্বয় করা হয়েছে।’
শুটিংয়ে লাইট সরবরাহের দায়িত্বে ছিলেন মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শুনেছি পিকআপ দেখে আমার ছেলেরা নেমে যেতে চেয়েছে। কিন্তু এরপরও ওদের এভাবে পাঠানো হয়েছে। লাইট হাউসমালিকের তো জানার কথা নয়, কোন জিনিস কীভাবে যাবে। তবে এর সমন্বয়ে ছিল লাইট গ্রাফার বাবু। সব বিষয় তাঁর জানার কথা।’
বাবু জানান, জেনারেটরমালিকের গাফিলতির কারণে গাড়ি ছাড়তে দেরি হয়। এরপর সবার সম্মতিতেই এভাবে পাঠানো হয়েছে। বাবু বলেন, ‘সন্ধ্যায় বাসে রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও সবকিছু করতে করতে ভোর চারটা হয়ে যায়। এ সময় কোনো বাসের সুযোগ ছিল না। সবার সম্মতি নিয়েই এভাবে পাঠানো হয়েছে। কাউকে জোর করে পাঠাইনি।’
তবে বাবুর এ বক্তব্যকে অসত্য বলছে শুটিং লাইট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ সালাম। তিনি জানান, লাইট সহকারীরা এভাবে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু এরপরও তাঁদের জোর করে পিকআপে পাঠানো হয়েছে।সালাম বলেন, ‘পিকআপে ইউনিটের কাউকে এভাবে পাঠানোর নিয়ম নেই। এরপরও জোর করে আমাদের ছেলেদের পাঠানো হয়। লাইটসহ তারা নেমে যেতে চাইলে বারবার মিথ্যা বলা হয়, সামনে গাড়ি আছে। কিন্তু শেষে ওই পিকআপেই পাঠানো হয়।’ শুটিং লাইট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনও একই তথ্য দেন।
বিচার চাইলেন রবিন
অস্ত্রোপচারকক্ষের সামনে কথা হয় রবিনের সঙ্গে। ঠিকঠাক কথা বলে পারছিলেন না তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ফেরত আসতে পারব কি না, জানি না। তবে এর বিচার চাই। আমার জীবন শেষ হয়ে গেল।’ হাসপাতালে রবিনের পাশেই ছিলেন চলচ্চিত্র টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়া পেশাদার মৈত্রীর মহাসচিব আবু জাফর অপু। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিচার চাইলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এভাবে যাতে ইউনিট পরিবহন করা না হয়, এর জন্য বারবার বারণ করা হয়েছে। এরপরও এ অবহেলা করা হয়েছে। রবিন আজ হাত হারাল, অনেকের আরও বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েছে, এর দায় কে নেবে? এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অবহেলায় দায়ীদের শাস্তি চাই। যাতে করে আর কেউ এমন গাফিলতি না করার সাহস দেখাতে পারেন।’
চিকিৎসার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা
দুর্ঘটনাস্থলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠানো হয় রবিনকে। সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয় প্রাঙ্ক কিংয়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু ঢাকায় আসার পরই তাঁরা আর যোগাযোগ করেনি বলে অভিযোগ রবিনের। হাসপাতালে উপস্থিত কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। আবু জাফর অপু বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর টানা দুই দিন আর্থিক সজীবকে ফোনে পাইনি। গত চার দিনে তিনি বা তাঁর টিমের কাউকে হাসপাতালে পাইনি। আজ সোমবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় কল দিলে ফোন রিসিভ করেননি তিনি।’
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সজীব। অভিযোগকারীদের কাছে প্রশ্ন রেখে আজ বিকেলে তিনি বলেন, ‘আমি না করলে যাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা রবিনের জন্য কী করেছেন বলতে বলেন। আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম, আজ রাতে হাসপাতালে যাব।’