প্রশ্ন ফাঁসকারীদের অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেন

0
147
সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার ১২ ব্যক্তি, ছবি: সিআইডির সৌজন্যে

প্রশ্নপত্র ফাঁস করে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে শত শত শিক্ষার্থীকে। ১৬ বছরে ১০ বার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এর মাধ্যমে শতকোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। অন্তত ৮০ জন রয়েছেন এই চক্রে। তাদের বেশির ভাগই চিকিৎসক ও কোচিং সেন্টার পরিচালনায় যুক্ত। গতকাল রোববার ঢাকায় সিআইডির সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া এসব তথ্য জানান।

প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার ১২ জনের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৭ জন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। গত ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার চিকিৎসকরা হলেন– ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান, তাঁর স্ত্রী সোহেলী জামান, মো. আবু রায়হান, জেডএম সালেহীন শোভন, জোবাইদুর রহমান জনি, জিল্লুর হাসান রনি ও ইমরুল কায়েস হিমেল। অন্যরা হলেন– জহির ইসলাম ভুঁইয়া মুক্তার, রওশন আলী হিমু, আক্তারুজ্জামান তুষার , জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার। জিজ্ঞাসাবাদে তারা শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম বলেছেন, যারা প্রশ্ন পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। অনেকে পাস করে চিকিৎসকও হয়ে গেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, যদি বুঝতে পারতেন– শেষ পর্যন্ত ধরা পড়বেন, তাহলে গোপনে দেশের বাইরে পাড়ি জমাতেন।

সংবাদ সম্মেলনে সিআইডিপ্রধান বলেন, ২০২০ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁস-সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তে নেমে জসীম উদ্দীন ও মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই চক্রের মূল হোতা জসীম। তাঁর খালাতো ভাই সালাম স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান। তারা আদালতে জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে গ্রেপ্তার ১২ জনের নাম আসে। এই ১২ জন পলাতক ছিলেন। ২০০১ থেকে পরবর্তী ১৬ বছরে চক্রের সদস্যরা ১০ বার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ব্যাংকের অনেক চেক ও পরীক্ষার প্রবেশপত্র জব্দ করা হয়েছে। তাদের ব্যাংক হিসাব নম্বর বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন কিনা– খতিয়ে দেখা হবে।

সিআইডির একটি সূত্রে জানা গেছে, চক্রটি দুই ভাগে কাজ করেছে। একটি গ্রুপ প্রেস কর্মচারী সালামের মাধ্যমে প্রশ্ন সংগ্রহ করে। তার খালাতো ভাই জসীম চিকিৎসকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র কোচিং সেন্টারে পৌঁছান। গত ১৬ বছরে এই চক্র প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। এদের মধ্যে ২৫০ জন শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এই চক্রের আরও ২০ জন চিকিৎসককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে মেডিকেল ও ২০১৭ সালে ডেন্টালের প্রশ্ন ফাঁস করেন তারা। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার সাত চিকিৎসকের মধ্যে তিনজন সিআইডির কাছে রিমান্ডে আছেন।  চার দিনের রিমান্ডে আছেন ময়েজ উদ্দিন। দুই দিনের রিমান্ডে আছেন তাঁর স্ত্রী সোহেলী জামান। জিজ্ঞাসাবাদে সোহেলী কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। ময়েজের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার পর ২০২০ সালে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে ইমিগ্রেশন বিভাগ ব্যবস্থা নেয়। তাঁর পাসপোর্ট ব্লক করে দেওয়া হয়েছিল। গ্রেপ্তার এড়াতে দীর্ঘ দিন পলাতক ছিলেন তিনি।

গ্রেপ্তার ১২ জনের পরিচয় 

সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেপ্তার ময়েজ উদ্দিন প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ফেইম নামের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়ান। তিনি অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মানি লন্ডারিং উভয় মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ময়েজ ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। পরে তিনি জামায়াতের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পান। তাঁর স্ত্রী সোহেলী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে ময়েজের সঙ্গে চক্রে যুক্ত হন।  সোহেলী জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক।

গ্রেপ্তার আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হন। পরে নিজেই এই চক্রে জড়ান। কোচিং সেন্টার চালাতেন রায়হান। সর্বশেষ কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাক্তারি করতেন। জেড এম সালেহীন শোভন প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেন। পরে থ্রি-ডক্টরস নামের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে চক্রের সঙ্গে জড়িত হন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে তিনি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র‍্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের নেতা ছিলেন শোভন।

জোবাইদুর রহমান জনি মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। তিনি ২০০৫ সালে এই চক্রে যুক্ত হন। দেশের নামকরা অনেক ডাক্তারের সন্তানদের অবৈধ পন্থায় মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দেন। তিনি জসীমের অন্যতম সহযোগী। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গাড়ি-বাড়ি করাসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন জনি। অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক হন। বর্তমানে তিনি যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক। মেডিকো কোচিং সেন্টারের সারাদেশে ১৮টি শাখা আছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের পাশাপাশি তারা ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেও মেডিকেলে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছেন।

জিল্লুর হাসান রনি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসক। তিনি ২০০৫ সালে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় তিনি র‍্যাবের হাতে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। রংপুর মেডিকেলে পড়ার সময় তিনি ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। তিনি বর্তমানে ড্যাবের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া তিনি বিএনপির আহত নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত দলের একজন সদস্য।

ইমরুল কায়েস তাঁর বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জড়ান। ইমরুল ময়মনসিংহের বেসরকারি কমিউনিটি-বেজড মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেন। জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য। তিনি জসীমের বড় ভাই। মুক্তার নিজেই একটি ছোট চক্র গড়েছিলেন। তিনি অনেক শিক্ষার্থীকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন।

রওশন আলী চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রওশন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত। আক্তারুজ্জামানও জসীমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ই-হক কোচিং সেন্টার চালাতেন তিনি। ২০১৫ সাল থেকে তিনি এই চক্রে জড়ান।

জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পীও জসিমের সহচর ছিলেন। তিনি ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামের একটি ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। তিনি প্রাইমেট, থ্রি-ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতেন। আব্দুল কুদ্দুস সরকার টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি অবসরে গেছেন। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার ওরফে কলিকে ভর্তির মাধ্যমে তিনি এই চক্রে জড়ান। পরে ছেলে ইমরুল কায়েসকে নিয়ে টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের আরেকটি চক্র। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীম ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল যেতেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.