পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে তাঁদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় আতঙ্ক কাটেনি। ক্ষতিগ্রস্তরা ভয়ে বাড়ি ফিরছেন না। রোববারও মাঠেঘাটে রাত কাটিয়েছেন তাঁরা। এদিকে ঘটনার চার দিন অতিবাহিত হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসনের তৎপরতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। অনেকে বলছেন, সময়মতো কঠোর পদক্ষেপ নিলে এত ভয়াবহ ঘটনা ঘটত না। এর আগে ২০১৯ সালেও সালানা জলসা ঘিরে হামলা হয়েছিল। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তখন থানায় অভিযোগ করা হলেও মামলা নেয়নি পুলিশ।
হামলার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করা হচ্ছে। পঞ্চগড় জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবু সালেক বলেছেন, প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে। আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে জানমালের এত ক্ষতি হতো না। গ্রেপ্তারের নামে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, যে দলেরই হোক, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা উচিত। সাবেক এমপি ও বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরও এমন ঘটনা ঘটেছিল। তখন প্রশাসন নীরব দর্শক ছিল। এবারেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, হামলা ঠেকাতে পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মজাহারুল হক প্রধান বলেন, বহিরাগত লোকজন এসে পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালিয়েছে। তবে প্রশাসন চেষ্টা চালালে বিষয়টি এতদূর গড়াত না। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এ হামলার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে বলেছেন, প্রশাসনের কোনো গাফিলাতি রয়েছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সোমবার সকালে জেলা শহরের আহমদনগরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম গতকাল বলেছেন, এ ঘটনায় বিভাগীয় পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শঙ্কা নেই। আহমদনগর এলাকায় পুলিশ-বিজিবি সমন্বয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা গুজব ছড়িয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। তবে প্রশাসনের এমন বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারেননি ভুক্তভোগীরা। গতকাল রেলমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে গেলে তাঁর সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এদিকে দু’জনকে হত্যাসহ তাণ্ডবের ঘটনায় ছয়টি মামলায় ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পঞ্চগড়ের প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষ বলছেন, বৃহস্পতিবার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসা বন্ধসহ তাঁদেরকে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের ইন্ধনেই তাণ্ডব চালানো হয়েছে। হামলাকারীদের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রয়েছে তাঁদের। পৃথকভাবে পাঁচটি সংগঠনের পক্ষে তাঁরাই সেদিন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসা বন্ধসহ তাঁদেরকে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন। তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করলেই তাণ্ডবের আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। তবে ওই পাঁচ সংগঠনের নেতাদের দাবি– তাঁরা জলসা বন্ধের আবেদন করেছেন, কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৃতীয় কোনো শক্তি হামলা করেছে।
গত শুক্রবার সকালে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সালানা জলসা শুরু হয় পঞ্চগড় জেলা সদরের আহমদনগরে। কিন্তু এতে বাদ সাধে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মোয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ সমর্থক মুসল্লিরা। এ পাঁচটি সংগঠনের নেতৃত্ব দেয় সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদ। জলসা বন্ধের দাবিতে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে তারা। ওই দিন পঞ্চগড়ে মহাসড়ক অবরোধসহ বিক্ষোভ করে এসব সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িতে প্রথম হামলার ঘটনাও ঘটে সেদিন। শুক্রবার জুমার নামাজের পর ওই দাবিতে শহরে ব্যাপক তাণ্ডব চালায় তারা। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পঞ্চগড়। বাধ্য হয়ে প্রশাসন রাত ৮টায় জলসা বন্ধ করে দেয়। এর পরও দুর্বৃত্তরা ওই সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। শনিবার রাতে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে জেলা শহরে। গুজব ছড়িয়ে কিছু যুবক লাঠিসোটা নিয়ে সড়কে নামে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গুজবে কান না দিয়ে শহরের বিভিন্ন মসজিদের মাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো, এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশসহ বিজিবি মোতায়েন করে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়।
পঞ্চগড় জেলা সদরের এক কিলোমিটার দূরেই আহমদিয়াপল্লি। আহমদনগর, ফুলতলা, শালশিরী, মানিকপীর এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের প্রায় তিন হাজার পরিবারের বাস। শুক্রবারে সবাই জলসা মাঠে অবস্থান করছিলেন। বাড়ি ফাঁকা থাকার সুযোগে দৃর্বৃত্তরা হামলা চালায়। হামলা ও অগ্নিসংযোগে ১৭১ পরিবারের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও লুটপাট হয়েছে।
বাড়িগুলোতে সাদা পাতাকা ঝুলিয়েছে কারা: হামলার আগের দিন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়ি শনাক্তের জন্য অন্য বাড়িগুলোতে সাদা পতাকা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এতে দুর্বৃত্তরা সহজেই আহমদিয়াদের বাড়ি শনাক্ত করে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। সোমবারও কয়েকটি বাড়িতে সাদা পতাকা ঝুলতে দেখা যায়। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই পতাকা টাঙানোর বিষয়ে খোঁজখরব নেওয়া শুরু হলে অনেকেই তা খুলে ফেলে। শালশিরী গ্রামের হাফিজ উদ্দিন বলেন, লোকজনের মুখে শুনি, যাদের বাড়িতে সাদা পতাকা থাকবে, তাদের বাড়িতে হামলা হবে না। হামলার হাত থেকে বাঁচতে বাড়িতে সাদা পাতাকা লাগাই। এ সময় আমার বাড়িতে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েকজন আশ্রয় নেন। কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।
পুলিশের সামনেই হামলার অভিযোগ : আহমদনগরে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। রোববার থেকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বাসিন্দারা ভয়ে ঘরে ফিরছেন না। আহমদনগরের ডা. রেজাউল করিম বলেন, শনিবারও গুজব তুলে বেশ কিছু দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। বিশেষ করে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিশ্চিত হয়ে হামলা চালানো হয়। রফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, পুলিশের সামনেই তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়। তাঁর সাত বছরের শিশু মানুষ দেখলেই ভয়ে আঁতকে ওঠে এখনও। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, করতোয়া নদীপাড়ের গ্রাম আহমদনগর। দুর্বৃত্তরা নদী পার হয়ে এসে হামলা চালায় এবং লুটপাট করে অনেক কিছু নিয়ে যায়।
শাড়ি চাল কম্বল বিতরণ : রেলমন্ত্রী ও পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম সুজন সোমবার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শাড়ি, চাল, কম্বল ও নগদ টাকা বিতরণ করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, ধর্ম পালনসহ সব ক্ষেত্রে জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি সংস্কার করা হবে। রেলমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ পরিবারের মাঝে একটি করে শাড়ি, লুঙ্গি, কম্বল প্রদান করেন। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে চালসহ রেলমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল থেকে পরিবারপ্রতি ১ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। তবে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের গণসংযোগ ও প্রেস বিভাগের প্রধান আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, আমরা কারও সাহায্য-সহযোগিতা চাই না। আমরা শুধু নিরাপদে বসবাস করতে চাই। নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা চাই। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের আহমদ জাফর বলেন, আমরা সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাই।
ছয় মামলায় আসামি ৮২০০: হামলার পর থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট ৮১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আসামি করা হয়েছে ৮ হাজার ২০০ জনকে। বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা জানান, ওই ঘটনায় আরও মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলেও জানান তিনি। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জাহিদ হাসানকে হত্যার অভিযোগে শনিবার রাতে ওসমান আলী বাদী হয়ে সদর থানায় একটি মামলা করেছেন। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। এদিকে হামলা, ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধাদানসহ বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশের করা মামলায় ১২ জনের নামসহ ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মোটরসাইকেল চালিয়ে এবং সামাজিকমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশের করা আরেকটি মামলায় ১৫ জনের নামসহ ২ হাজার ৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারদের মধ্যে ঘটনায় জড়িত বিএনপি-জামায়াত নেতারাও রয়েছেন।
বিএনপির নেতাকর্মীকে হয়রানির অভিযোগ : বিএনপি সূত্র জানায়, শুক্রবারের সালানা জলসার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ করেছিলেন সাধারণ মুসল্লিরা। এ নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। তারা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরও কঠোর ব্যবস্থা নিলে এমন ঘটনা ঘটত না। এখন ঢালাওভাবে পাঁচ উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, রোববার রাতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁদের ৪০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকের বাসায় তল্লাশির নামে নেতাকর্মীর মাঝে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। তাঁরা সবাই নিরপরাধ, কোনোভাবেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সিসিটিভি এবং ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখলে তা স্পস্ট হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে তাঁদের নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে।