প্রশাসনকে আস্থায় রাখার চেষ্টা দুই পক্ষের

0
139

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপি প্রশাসনকে তুষ্ট রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনের বেশি পদোন্নতি, বেতন বাড়ানো, আর্থিক সংকটেও নতুন গাড়ি, বিভাগীয় শাস্তিতে নমনীয়, বীমাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষ ভবিষ্যতে বৈরী আচরণ না করার ব্যাপারে আশ্বাস দিচ্ছে।

ব্যতিক্রম না হলে আগামী জানুয়ারির মধ্যে হবে জাতীয় নির্বাচন। গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর সরকারি কর্মকর্তাদের একটি পক্ষে ‘ভীতি’ কাজ করছে। এর মধ্যে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পছন্দ-অপছন্দের কর্মকর্তাদের তালিকা করার খবরও চাউর হয়। এসব ছাপিয়ে সর্বশেষ সরকার ও রাজপথের বিরোধী দল সরকারি কর্মচারীদের নিজেদের পক্ষে টানার প্রকাশ্য বার্তা দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বার্তা
গত ২৫ জুলাই মধ্যরাতে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘কর্তৃপক্ষের বেআইনি আদেশে বা চাপে পড়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এতদিন অন্যায়, অবৈধ ও বেআইনি কাজ করেছেন; তারা এখন থেকে যদি আর এ ধরনের কাজ না করেন, তাহলে তাদের আগের ভূমিকা সহানুভূতি ও ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে।’

ওই রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম লিখিত বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের অতি নগণ্যসংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ ও দলবাজ কর্মকর্তা অপপ্রচার চালাচ্ছেন– বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুতি, জেল-জরিমানার মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হবে।’ কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে বিএনপি বিবৃতিতে বলেছে, ‘এমন শঙ্কার কোনো কারণ নেই। বরং বিএনপি দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরির সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।’

একই সঙ্গে গত ১৫ বছরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করার আশ্বাস দেওয়া হয়।
এর পরই ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসন দিবস উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘সামান্য আন্দোলন দেখে ভয় পাবেন না। যতক্ষণ জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে, ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই।’ কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করে সরকারপ্রধান আরও বলেন, ‘জীবনে সমস্যা আসবে, এটা স্বাভাবিক। তবে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হলে মনোবল ও শক্তি প্রয়োজন।’ শেখ হাসিনা সরকারি কর্মচারীদের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, জনগণের সেবা করা আপনাদের দায়িত্ব।

সংকটেও বাড়ছে সুবিধা
করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির এ দুঃসময়েও সরকারি চাকুরেদের বেতন ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনায় কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে নমনীয় আচরণ দেখা গেছে; অনেক ক্ষেত্রে সরকারি তদন্তে দোষ প্রমাণ হওয়ার পরও মিলেছে ক্ষমা। ডলার সংকটের মধ্যেও বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে ডিসি-ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বশেষ সব সরকারি চাকুরের জন্য বীমা সুবিধার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সম্প্রতি পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। এর মধ্যে অ্যাডিশনাল আইজি গ্রেড-১ পদমর্যাদার ১৫, একই পদে গ্রেড-২ পদমর্যাদার ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ এবং পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ১৯০টি পদের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সাবেক কর্মকর্তাদের মত
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রশাসনের প্রতি এমন আহ্বানকে পর্যবেক্ষকরা দু’দিক থেকেই ক্ষতিকর বলছেন। সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, ‘দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত না হলে এমন আহ্বানই আসবে। যে যা-ই বলুক, ক্ষমতায় আসার আগে সবাই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে। ক্ষমতায় এলে তাদের আসল চেহারা দেখা যায়।’

দুই পক্ষের আহ্বানে আপাতদৃষ্টিতে পক্ষে টানার চেষ্টা থাকলেও প্রচ্ছন্ন হুমকিও আছে বলে মনে করেন প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে কাজ করা সাবেক এক সিনিয়র সচিব। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্রিটিশ ধাঁচের আমলাতন্ত্র প্রচলিত, অর্থাৎ এটি স্থায়ী পদ্ধতি। যারা সরকারি চাকরিতে আছেন, তারা এমনিতেই সুরক্ষার মধ্যে আছেন। যে রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র পরিচালনা করুক, আমলাতন্ত্র তাদের নীতি বাস্তবায়নে কাজ করবে। রাজনৈতিক বক্তৃতায় কর্মচারীদের বিষয়ে এমন বার্তা না থাকাই ভালো।’

কর্মরতরা কী ভাবছেন
সরকারি ও বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতার পক্ষ থেকে এমন আহ্বানে নানা আলোচনা হচ্ছে প্রশাসনে। তবে কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। প্রচ্ছন্নভাবে সরকারি দলের রাজনীতি সমর্থন করেন– এমন কর্মকর্তারা বলছেন, “বিএনপির আহ্বানে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। তারা একদিকে বলছে, কারও বিরুদ্ধে বৈরী আচরণ করবে না; আবার এও বলছে, ‘নগণ্যসংখ্যক’ দুর্নীতিবাজ ও দলবাজ কর্মকর্তা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই নগণ্যসংখ্যক কর্মকর্তার সংখ্যাটা কত, এর সংজ্ঞা কী? এদের বিরুদ্ধে যে বিএনপি আক্রোশ ঝাড়বে, তাদের লিখিত বিবৃতি পড়লেই বোঝা যায়।”

অন্যদিকে, যোগ্যতা থাকার পরও বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতিবঞ্চিত বা পরে পদোন্নতি পেলেও ভালো পোস্টিং পাননি– এমন হতাশায় থাকা কর্মকর্তারা বিএনপির দেওয়া বিবৃতিতে নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখছেন। অবসরে যাওয়ার কাছাকাছি থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসনে ন্যায়ভিত্তিক পদোন্নতির ধারা তৈরি হয়নি। যাঁর লবিং ভালো, তিনি ভালো অফিসার না হলেও পদোন্নতি আটকাচ্ছে না। আর যাদের লবিং নেই, তাদের অনেকের যোগ্যতা থাকার পরও প্রত্যাশিত পদোন্নতি হচ্ছে না।

প্রশাসনের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা কর্মকর্তারা কোনো দিকেই শতভাগ ঝুলে পড়ার পক্ষপাতী নন। তারা বলছেন, ‘যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের আনুগত্য করাই সরকারি চাকুরেদের কাজ। তারপরও যে দলের সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাল না মেলালে টিকে থাকা যায় না।’ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, টানা দেড় দশকের শাসনামলে এদিক দিয়ে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। কারণ বিগত বছরগুলোতে ব্যাপক পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে আরও দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

ছোট ঘটনায় বড় আলোচনা
গত রোববার নাটোরের সিংড়া উপজেলা চত্বরের গণশুনানিতে ওসি মিজানুর রহমানের ওপর ক্ষোভ ঝারেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। ওই রাতেই ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। পরদিন সোমবার দুপুরে ওসির প্রত্যাহার আদেশ বাতিল করে সিংড়া থানায় পুনর্বহাল করা হয়।
ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জানা গেছে, জনসমক্ষে ওসির ওপর প্রতিমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করার বিষয়টি পুলিশের নিম্ন থেকে উচ্চ মহল পর্যন্ত ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওসি মিজানুরকে পুনর্বহালের জন্য আইজিপি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন।

যা বললেন প্রতিমন্ত্রী

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি রাজনৈতিকভাবে তাদের বক্তব্য দিয়েছে। এটি তাদের বিষয়। এতে প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা নেই।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের প্রশাসন সেভাবেই দায়িত্ব পালন করছে। আমাদের আমলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্ভয়ে কাজ করতে পারছে। প্রশাসনের যা প্রয়োজন, সে অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এখানে কাউকে খুশি করার কিছু নেই। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের সবাই নিজ নিজ যোগ্যতায় কাজ করছেন। যাদের যা প্রাপ্য, সরকার সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে।’ উদাহরণ দিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কিছুদিন আগে অনেক জেলার ডিসি বদল করা হয়েছে। যেসব ডিসি মাঠে দুই-তিন বছর দায়িত্ব পালন করে ফেলেছেন, তাদের স্বাভাবিকভাবেই বদলি করে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়। এর বাইরে দু-একজনের কাজের মূল্যায়ন করে জেলা বদল বা অন্য জায়গায় বদলি করা হয়। এগুলো প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.