প্রয়োজন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত

0
113
বদিউল আলম মজুমদার

সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পূর্বশর্ত। বস্তুত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনরা অপারগতা প্রদর্শন করে আসছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সে ব্যবস্থা ছিল একটি রাজনৈতিক সমঝোতা তথা বন্দোবস্ত। এর দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং অনেক গড়িমসির পর ব্যবস্থাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয় বিএনপি। এ বন্দোবস্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের পথই শুধু সুগম করেনি; সব রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার সমসুযোগও সৃষ্টি করেছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে এই বন্দোবস্তের ওপর প্রথম ধাক্কা আসে ২০০৪ সালে; বিএনপি সরকার সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ২০১০ সালের ১০ মে, আপিল বিভাগের এক ‘সংক্ষিপ্ত’ আদেশের হাত ধরে। এ আদেশে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ‘প্রসপেকটিভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য– ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর– তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। যদিও এর আগে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানসম্মত বলে রায় দিয়েছেন। তবে ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তটি ভেঙে দেওয়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে; আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে পাসের মাধ্যমে, যা সংবিধানকে অস্ত্রে পরিণত করেছে।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে নবম জাতীয় সংসদ ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে, যার ১২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই বিশেষ সংসদীয় কমিটি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ মোট ১০৪ জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রেখেই ২০১১ সালের ২৯ মে সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত প্রস্তাব করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কমিটির সুপারিশ বদলে যায় এবং কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়েই সংবিধান সংশোধনের চূড়ান্ত প্রস্তাব করে। প্রসঙ্গত, ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন– পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে, যা সঠিক নয়।

এটি সুস্পষ্ট, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ উপেক্ষা করে; আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এবং আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এটি ছিল একটি স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত। কারণ এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে একই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। গবেষক ড. আদিবা আজিজ খানের মতে, ‘বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং ভোটারদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরও দুই জাতীয় নির্বাচনের সময় বহাল থাকার আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেছে।’

পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের বিধ্বংসী পরিণতি হলো, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে দুটি বিতর্কিত নির্বাচন, যার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বস্তুত আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে সাতটি দলীয় সরকারের; অন্য চারটি অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে চারটি ছাড়া বাকি সব নির্বাচনেরই গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।

সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পূর্বশর্ত। বস্তুত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে শুরু থেকেই ক্ষমতাসীনরা অপারগতা প্রদর্শন করে আসছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সে ব্যবস্থা ছিল একটি রাজনৈতিক সমঝোতা তথা বন্দোবস্ত। এর দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং অনেক গড়িমসির পর ব্যবস্থাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয় বিএনপি। এ বন্দোবস্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের পথই শুধু সুগম করেনি; সব রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়ার সমসুযোগও সৃষ্টি করেছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে এই বন্দোবস্তের ওপর প্রথম ধাক্কা আসে ২০০৪ সালে; বিএনপি সরকার সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় ধাক্কা আসে ২০১০ সালের ১০ মে, আপিল বিভাগের এক ‘সংক্ষিপ্ত’ আদেশের হাত ধরে। এ আদেশে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ‘প্রসপেকটিভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য– ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর– তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন। যদিও এর আগে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানসম্মত বলে রায় দিয়েছেন। তবে ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক বন্দোবস্তটি ভেঙে দেওয়া হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে; আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে পাসের মাধ্যমে, যা সংবিধানকে অস্ত্রে পরিণত করেছে।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে নবম জাতীয় সংসদ ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে, যার ১২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এই বিশেষ সংসদীয় কমিটি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ মোট ১০৪ জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রেখেই ২০১১ সালের ২৯ মে সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত প্রস্তাব করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কমিটির সুপারিশ বদলে যায় এবং কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দিয়েই সংবিধান সংশোধনের চূড়ান্ত প্রস্তাব করে। প্রসঙ্গত, ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন– পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে, যা সঠিক নয়।

এটি সুস্পষ্ট, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সুপারিশ উপেক্ষা করে; আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এবং আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এটি ছিল একটি স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত। কারণ এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে একই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। গবেষক ড. আদিবা আজিজ খানের মতে, ‘বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং ভোটারদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আরও দুই জাতীয় নির্বাচনের সময় বহাল থাকার আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেছে।’

পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের বিধ্বংসী পরিণতি হলো, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে দুটি বিতর্কিত নির্বাচন, যার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বস্তুত আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে সাতটি দলীয় সরকারের; অন্য চারটি অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে চারটি ছাড়া বাকি সব নির্বাচনেরই গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।

পঞ্চদশ সংশোধনীর গ্রহণযোগ্যতা এবং সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। সংবিধান বাংলাদেশের ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি,’ তাই তাদের সম্মতি ছাড়া এটির সংশোধন অগ্রহণযোগ্য। বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান না থাকলেও, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; যদিও পরে উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। তবে গণভোটের বিধানটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমঝোতার ভিত্তিতে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, গণভোট দেওয়া হলে নিঃসন্দেহে এটি প্রত্যাখ্যাত হতো। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এ ছাড়াও পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগে এ নিয়ে কোনো সুচিন্তিত বিতর্কও হয়নি। বিরোধী দলেরও এতে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না– বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে একটি নাম প্রস্তাবের আহ্বান করা হলেও বিএনপি তা করেনি এবং সংশোধনীটি পাসের সময়ও তারা সংসদে অনপুস্থিত ছিল। তাই পঞ্চদশ সংশোধনীতে জনগণের সম্মতি তো ছিলই না; এতে বিরোধী দল, এমনকি বিশেষ সংসদীয় কমিটির ১৫ সদস্যেরও সত্যিকারের সম্মতি ছিল না।

পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমত, গণভোটের আয়োজন না করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস ছিল বিদ্যমান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। দ্বিতীয়ত, বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নাকচ করা ক্ষমতার পৃথককরণ  নীতির লঙ্ঘন। তৃতীয়ত, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে সংশোধন-অযোগ্য করা হয়। একমাত্র সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অসংশোধনযোগ্য। তাই সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে অসংশোধনযোগ্য করার মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতত্ত্বই লঙ্ঘিত হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এক সংসদ পরবর্তী সংসদের হাত-পা বেঁধে দিতে পারে না।

পাশাপাশি, বিচারপতি খায়রুল হকের প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণার পাশাপাশি এটিকে পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য জীবন্ত রাখা হয়েছিল। এটা কি আদালতের পক্ষ থেকে সংসদের কাজে হস্তক্ষেপের শামিল নয়? এটা স্পষ্টতই ক্ষমতা পৃথককরণের নীতির লঙ্ঘন।

শুনানিকালে আদালতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের আকুতি ছিল : ‘আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা ও জনগণের যে চরিত্র, তাতে এ ব্যবস্থা বাতিল হলে দেশে সামরিক শাসন আসবে। তাই এ দেশে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে অন্য কোনো পথ আমি দেখতে পাচ্ছি না। এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। অপপ্রয়োগের কারণে কোনো ব্যবস্থা বাতিল করা ঠিক হবে না।’ বলা বাহুল্য, সেই আকুতি বিফলে গেছে।

পরিশেষে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির কারণে সর্বগ্রাসী দলীয়করণ হয়েছে এবং পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ফলে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আরেকটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত না হলে আমাদের পরবর্তী নির্বাচনও বিতর্কিত হতে বাধ্য, যা জাতি হিসেবে আমাদের এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা, এমনকি সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই আজ আমাদের সবার গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য সোচ্চার হওয়া।

পঞ্চদশ সংশোধনীর গ্রহণযোগ্যতা এবং সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। সংবিধান বাংলাদেশের ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি,’ তাই তাদের সম্মতি ছাড়া এটির সংশোধন অগ্রহণযোগ্য। বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান না থাকলেও, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়; যদিও পরে উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। তবে গণভোটের বিধানটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমঝোতার ভিত্তিতে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, গণভোট দেওয়া হলে নিঃসন্দেহে এটি প্রত্যাখ্যাত হতো। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। এ ছাড়াও পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগে এ নিয়ে কোনো সুচিন্তিত বিতর্কও হয়নি। বিরোধী দলেরও এতে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না– বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে একটি নাম প্রস্তাবের আহ্বান করা হলেও বিএনপি তা করেনি এবং সংশোধনীটি পাসের সময়ও তারা সংসদে অনপুস্থিত ছিল। তাই পঞ্চদশ সংশোধনীতে জনগণের সম্মতি তো ছিলই না; এতে বিরোধী দল, এমনকি বিশেষ সংসদীয় কমিটির ১৫ সদস্যেরও সত্যিকারের সম্মতি ছিল না।

পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রথমত, গণভোটের আয়োজন না করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস ছিল বিদ্যমান সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। দ্বিতীয়ত, বিশেষ সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নাকচ করা ক্ষমতার পৃথককরণ  নীতির লঙ্ঘন। তৃতীয়ত, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে সংশোধন-অযোগ্য করা হয়। একমাত্র সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অসংশোধনযোগ্য। তাই সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশকে অসংশোধনযোগ্য করার মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতত্ত্বই লঙ্ঘিত হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এক সংসদ পরবর্তী সংসদের হাত-পা বেঁধে দিতে পারে না।

পাশাপাশি, বিচারপতি খায়রুল হকের প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণার পাশাপাশি এটিকে পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য জীবন্ত রাখা হয়েছিল। এটা কি আদালতের পক্ষ থেকে সংসদের কাজে হস্তক্ষেপের শামিল নয়? এটা স্পষ্টতই ক্ষমতা পৃথককরণের নীতির লঙ্ঘন।

শুনানিকালে আদালতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের আকুতি ছিল : ‘আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা ও জনগণের যে চরিত্র, তাতে এ ব্যবস্থা বাতিল হলে দেশে সামরিক শাসন আসবে। তাই এ দেশে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে অন্য কোনো পথ আমি দেখতে পাচ্ছি না। এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব। অপপ্রয়োগের কারণে কোনো ব্যবস্থা বাতিল করা ঠিক হবে না।’ বলা বাহুল্য, সেই আকুতি বিফলে গেছে।

পরিশেষে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির কারণে সর্বগ্রাসী দলীয়করণ হয়েছে এবং পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ফলে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আরেকটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত না হলে আমাদের পরবর্তী নির্বাচনও বিতর্কিত হতে বাধ্য, যা জাতি হিসেবে আমাদের এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা, এমনকি সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই আজ আমাদের সবার গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য সোচ্চার হওয়া।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.