ভারতের রুশ তেল কেনা যেভাবে আধিপত্য কমাচ্ছে মার্কিন ডলারের

0
81
মার্কিন ডলার, ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে ডলারের আধিপত্য নিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু মার্কিন এ মুদ্রার আধিপত্য এখন পর্যন্ত বজায় রয়েছে, কারণ আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের ব্যবহার সবচেয়ে সুবিধাজনক এবং সবাই এটা গ্রহণ করে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর টালমাটাল হয় জ্বালানির বাজার। এ সময় রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বাড়িয়ে দেয় ভারত। আর রাশিয়ার সঙ্গে এই লেনদেন এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রমাণ দিচ্ছে যে অন্য মুদ্রায় তেলের বাণিজ্য করা সম্ভব এবং এটা দীর্ঘ মেয়াদে চলতেও পারে।

ভারত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ। গত বছর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপে রুশ তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর রাশিয়াই ভারতের তেলের জন্য সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে ওঠে।

গত ডিসেম্বরে রাশিয়ার তেলের দাম বেঁধে দেয় পশ্চিমা বিশ্ব। এরপর ভারতের আমদানিকারকেরা রাশিয়া থেকে যত তেল কিনেছে, তার দাম পরিশোধ করেছে ডলার বাইরে অন্য মুদ্রায়। তেলের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং ব্যাংকিং খাতের সূত্রগুলো বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, যেসব মুদ্রা ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিরহাম এবং রাশিয়ার রুবল।

সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, গত তিন মাসে যত লেনদেন হয়েছে, তার পরিমাণ হবে বেশ কয়েক শ কোটি ডলার। এটা এমন এক পরিবর্তন যে বিষয়ে খুব বেশি জানাজানি হয়নি।

জি-৭, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অস্ট্রেলিয়া গত বছর রাশিয়ার তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়। বেঁধে দেওয়া দামে তেল বিক্রি না করলে পশ্চিমা বিভিন্ন পরিষেবা সংস্থা ও জাহাজকে সেবা দেওয়া বন্ধ করতে বলা হয়। উদ্দেশ্য, মস্কো যাতে যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে না পারে।

তবে তিনটি সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক কয়েকটি সপ্তাহে বেঁধে দেওয়া ৬০ ডলারের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে—এমন কিছু ভালো মানের রুশ তেলের জন্য দুবাইভিত্তিক ব্যবসায়ী এবং রাশিয়ার জ্বালানি কোম্পানি গাজপ্রম ও রসনেফট ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রায় লেনদেন করতে বলেছে।

সূত্রগুলো নাম প্রকাশ করতে চায়নি, কারণ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর।

তবে রাশিয়ার যে পরিমাণ তেল ভারতের কাছে সাধারণত বিক্রি করা হয়, তার তুলনায় ওই সব বিক্রি ছিল খুবই কম। সম্ভবত, এ ক্ষেত্রে অবরোধ উপেক্ষিতও হয়নি, কারণ বিশ্লেষকদের মতে পশ্চিমা পরিষেবা না নিয়েও রাশিয়ার জাহাজ ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে এসব সেবা দেওয়া সম্ভব।

তবে ভারতের তেল কেনার ক্ষেত্রে তিনটি ব্যাংক কিছু লেনদেনে নিশ্চয়তা দিয়েছে বলে ব্যবসায়ী সূত্র এবং সাবেক কয়েকজন রুশ ও মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন।
কিন্তু দিরহামে লেনদেন চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে, কেননা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন গত মাসে মস্কো ও আবুধাবি ভিত্তিক রুশ ব্যাংক এমটিএসকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যোগ করেছে। এমটিএস ভারতে কয়েকটি ডলারবিহীন লেনদেনে সহায়তা করেছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এমটিএস এবং মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রয়টার্স যোগাযোগ করলেও এ ব্যাপারে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তেল পরিশোধনের সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র বলছে, রাশিয়ার বেশির ভাগ ব্যাংক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকলেও ভারতের ক্রেতা এবং রাশিয়ার সরবরাহকারীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে তারা রুশ তেলের ব্যবসা চালিয়েই যাবেন। একটি সূত্র বলেন, ‘বিক্রি বাবদ অর্থ গ্রহণ করার জন্য রাশিয়ার সরবরাহকারীরা আরও কিছু ব্যাংক খুঁজে পাবে’।

‘সরকার আমাদের রুশ তেল কিনতে নিষেধ করছে না। তাই আমরা আশাবাদী বর্তমান ব্যবস্থা বন্ধ হলেও লেনদেনের বিকল্প একটা পথ খুঁজে পাওয়া যাবেই’, বলেছে ওই সূত্র।

বন্ধু বনাম বন্ধুত্বহীনতা

দশকের পর দশক ধরে ক্রেতারা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কিনছে এবং ডলারে দাম চুকাচ্ছে। সেই তুলনায় আন্তর্জাতিক লেনদেনে এই মুদ্রার অংশ অনেক কম—মাত্র ৪০ শতাংশ। লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফটের জানুয়ারি মাসের হিসাবে এটা দেখা গেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে উইড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সের ফেলো ড্যানিয়েল আন বলেন, শক্তিতে ডলারের সমকক্ষ কেউ নেই, তবে উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে আরোপ করা অবরোধ বরং পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে পারে।

ড্যানিয়েল আন বলেন, রাশিয়ার অন্য মুদ্রায় তেল বিক্রি সত্যিকার অর্থে অবরোধের প্রতি কোনো হুমকি নয়। তবে পশ্চিমাদের নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থায় আরেকটি আমলাতান্ত্রিক স্তর যোগ হওয়ার কারণে তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে।
রাশিয়ার তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছে সাগর পথে তেল আমদানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা। এর আগে ছিল অবরোধ, যার একটি অংশ ছিল বৈশ্বিক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়া।

রাশিয়ার স্বর্ণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের প্রায় অর্ধেক, যার পরিমাণ প্রায় ৬৪ হাজার কোটি ডলার, তা জব্দ করা হয়েছে।

রাশিয়া এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থাও নিয়েছে। তারা বলেছে, তারা জ্বালানির জন্য ‘বন্ধু’দেশের মুদ্রায় দাম পেতে চায়, আর ‘অবন্ধু’ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশকে গ্যাসের দাম দিতে হবে রুবলে।

স্বাধীন বিশ্লেষক এবং ব্যাংক অব রাশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা আলেক্সান্ড্রা প্রকোপেঙ্কো বলেন, নিষেধাজ্ঞা কিংবা বিলম্বের কারণে অনেক রুশ কোম্পানির জন্য ডলার ‘বিষাক্ত সম্পদ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘রাশিয়া তেল ও গ্যাস বিক্রির ওপর নির্ভরশীল, তাই বাকি বিশ্বের সঙ্গে তারা ব্যবসা করতে মরিয়া’।

আর সে কারণে তারা রাশিয়া ও ভারতের ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের একটি অবকাঠামো গড়ে তুলতে কাজ করছে বলে মনে করেন তিনি।

ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার একটি বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্ট রয়েছে রাশিয়ায়। একইভাবে বাণিজ্য করার সুবিধার জন্য অনেক রুশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট আছে ভারতে।

রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পরের মাসে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গীতা গোপীনাথ বলেছিলেন যে রাশিয়ার ওপর অবরোধ ডলারের প্রাধান্য ক্ষুণ্ন করতে পারে, কারণ ছোট ছোট বাণিজ্য অঞ্চল অন্য মুদ্রা ব্যবহার করতে উৎসাহিত হতে পারে।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমকে গীতা গোপীনাথ বলেন, ডলার একটি প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে থাকবে। কিন্তু এটা সম্ভব যে ছোট পর্যায়ে এটা থাকবে না। রয়টার্স আইএমএফের কাছে এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলেও তারা কোনো সাড়া দেয়নি।

রাশিয়া ছাড়াও উত্তেজনা চলছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। এটিও ডলারের দীর্ঘদিনের আধিপত্য কমাতে ভূমিকা রাখছে। রাশিয়া তাদের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের একটি অংশ রাখছে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে, অন্যদিকে চীন ডলারে রাখা মজুতের পরিমাণ কমিয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, মস্কো চীনের কাছে ডলার নয়, ইউয়ান ও রুবলে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়েছে।

ভারত ও ইউরোপ

রাশিয়া সমুদ্রপথে সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করত ইউরোপে। গত বছর ভারত সেই স্থান দখল করেছে। প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্য বলছে, যুদ্ধের আগের তুলনায় ভারত রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি ১৬ গুণ বাড়িয়েছে।

ভারত মস্কোর বিরুদ্ধে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাকে স্বীকৃতি দেয় না। তবু তারা যেসব তেল আমদানি করেছে, তার বেশির ভাগ সেটা মেনেই করা হয়েছে এবং প্রায় সব তেলই কেনা হয়েছে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে কম দামেই।

তারপরও বেশির ভাগ ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানই অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা না ভাঙার ব্যাপারে সচেতন আছে।

সূত্রগুলো বলছে, যেসব ভারতীয় কোম্পানি রাশিয়ার তেল আমদানির খরচ রুবলে মেটাচ্ছে, তারা সেটা করছে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার রাশিয়ায় থাকা রুবল হিসাবের মাধ্যমে। এসব তেলের বেশির ভাগ কেনা হয়েছে গাজপ্রম ও রসনেফট থেকে।

অন্যদিকে, দিরহামে লেনদেন করা হয়েছে ব্যাংক অব বরোদা এবং অ্যাক্সিস ব্যাংকের মাধ্যমে। রয়টার্স এদের সবার কাছে মন্তব্য চাইলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ভারত রাশিয়ার সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করার জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদি আরও বেশি নিষেধাজ্ঞার কারণে রুবলে লেনদেন একবারে বন্ধ হয়ে যায়, সেটাকে মাথায় রেখেই এই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য জানতে চাইলে তারা যুদ্ধের দুই সপ্তাহের মধ্যে করা মন্ত্রী জেনেট ইয়েলেনের বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি না ডলারের কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আছে এবং আরও অনেক বছরের মধ্যে তেমন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবেও না।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.