প্রধান চ্যালেঞ্জ আস্থা

জাতীয় ভোটার দিবস আজ

0
192
নির্বাচন কমিশনের (ইসি)

প্রতিবছর নতুন ভোটার বাড়ে দুই থেকে আড়াই শতাংশ। এবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) খসড়া তালিকার হিসাবে নতুন ভোটার বাড়ছে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। ভোটার হালনাগাদের এই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হতে যাচ্ছে আজ। সব মিলিয়ে এখন দেশে ভোটার সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১২ কোটি। একই সঙ্গে ‘ভোটার হব নিয়ম মেনে, ভোট দিব যোগ্যজনে’– এ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার সারাদেশে পঞ্চমবারের মতো পালিত হচ্ছে জাতীয় ভোটার দিবস। এ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ইসি।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহারে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের ফলে এখন আর ভোটার তালিকায় নয়ছয়ের সুযোগ খুব একটা নেই। যদিও ভুয়া পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির প্রবণতা রয়েছে। তবে ভোটারের পছন্দে যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ভোট নিয়ে এক ধরনের আস্থার সংকট রয়েছে।

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটার তালিকায় ভুয়া ও দ্বৈত ভোটার ইস্যুতে একসময় রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক লড়াই হয়েছে। এখন আর সেই বিতর্ক নেই। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর বিরোধ থাকলেও ভোটার তালিকা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক এখন তেমন একটা হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনী ব্যবস্থায় নানা অনিয়মের অভিযোগ অব্যাহত থাকলেও ইসির তরফে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। নির্বাচন কমিশনের কর্তারা এসব অনিয়ম দূর করার পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো অনিয়মের পক্ষে সাফাই গাওয়ার পথে হাঁটছেন। ফলে ধীরে ধীরে ভোটকেন্দ্রবিমুখ হচ্ছেন সাধারণ ভোটাররা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে ১৫৩ সংসদ সদস্য বিনা ভোটে জয়ী হন। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনগুলোতেও এই ধারা বিস্তার লাভ করে।

অবশ্য ভোটার দিবস উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, বর্তমান কমিশনকে সব রাজনৈতিক দলের আস্থায় নেওয়া উচিত। কারণ, এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না।

আরেক কমিশনার আহসান হাবীব খান বলেন, ভয়ভীতিহীন নির্বাচন ও নির্বিঘ্ন পরিবেশ করতে কমিশন সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে। আমাদের মেয়াদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে যেখানে বাধা বা অনিয়মের অভিযোগ এসেছে, সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, এ পর্যন্ত বর্তমান ইসির অধীনে পাঁচ শতাধিক নির্বাচন হয়েছে। এসব ভোটে নির্ভরযোগ্য কোনো অভিযোগ তো আসেইনি এবং সংক্ষুব্ধ কেউ আদালতের দ্বারস্থ হননি। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে অবাঞ্ছিত লোকের উপস্থিতি ও কেন্দ্রে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা অবশ্য ইসির এই অবস্থানের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সব মহলে গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ১৯৯১ (পঞ্চম সংসদ), ১৯৯৬ (সপ্তম সংসদ), ২০০১ (অষ্টম সংসদ) এবং ২০০৮ (নবম সংসদ) নির্বাচনকে ধরা হয়। এই চার নির্বাচনের মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ ও দুটিতে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। সম্প্রতি বিএনপির পদত্যাগে শূন্য হওয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ।

কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সর্বজন গ্রহণযোগ্য চারটি সংসদ নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়েছিল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। বাংলাদেশের ভোটের সংস্কৃতিতে এটা প্রমাণিত, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ ভোটাররা আস্থা রাখতে পারছেন না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন এর জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ওই চারটি সংসদ নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পরাজিত হলেও দলগতভাবে তারা ৩০ শতাংশ বা তার কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল। এখনকার নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতির হার তার চেয়েও কম। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, যারা আওয়ামী লীগকে সব সময় ভোট দেয়, তারাও এখন ভোটকেন্দ্রে যান না।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ জন্য ইসিকে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের আয়োজন কারও জন্য সুফল বয়ে আনবে না।

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড গড়ে। ওই ভোটে উপস্থিতির হার ছিল মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। তারও আগে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইভিএমের ব্যাপক প্রচারের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ২৯ শতাংশ ও উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোটের হার ছিল ২৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আর বর্তমান ইসির অধীনে গাইবান্ধা-৫ আসনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৩৮ শতাংশ। তাদের মতে, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধ না মিটলে, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা অসম্ভব।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের মতে, এই সংখ্যা কমার পেছনে যত যুক্তিই দেওয়া হোক না কেন, তথ্য বিশ্লেষণে এটা পরিষ্কার যে প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচনে ভোটাররা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, আগের বছরগুলোতে উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারগুলো বহু বছর ধরে প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়ায় ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসার তাগিদ হারিয়েছেন।

আজকের কর্মসূচি : ভোটার দিবস উপলক্ষে আজ সকাল সাড়ে ৮টায় নির্বাচন ভবনের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রমের সূচনা হবে। বিকেল ৪টায় নির্বাচন ভবন মিলনায়তনে ভোটার দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা এতে উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ভোটার দিবসে দক্ষতা ও কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনের তিন চৌকস কর্মকর্তাকে জাতীয় নির্বাচনী পদক দেওয়া হবে।

পাশাপাশি ঢাকাসহ আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নানা কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়েও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় ভোটার দিবস পালন করা হবে। এ উপলক্ষে মাঠপর্যায়ে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভারও আয়োজন করা হয়েছে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.