আলোচনা-সমালোচনার পর শুক্রবার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিকবিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বই দুটির পাঠদানে আপাতত স্থগিত রাখতে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি পাঠ্যবইয়ে শিগগিরই সংশোধনী আনা হবে। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে শিগগিরই সংশোধনের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি।
বই দুটি মাঠ পর্যায় থেকে ফেরত নেওয়ার পর নতুন করে বই ছাপানো হবে কিনা জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, অনুসন্ধানী পাঠ আর ছাপানো হবে না। তবে অনুশীলনী পাঠ পরিমার্জন করে পুনরায় দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে কনটেন্ট অল্প হলে সংশোধনী পাঠানো হবে মাঠ পর্যায়ে, আর বেশি হলে বর্ধিত অংশ হিসেবে ফের ছাপানো হবে।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালকের নেতৃত্বে যে কমিটি সরকার গঠন করেছে, তারা এরই মধ্যে পরিমার্জনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
হঠাৎ করেই পাঠ্যবই প্রত্যাহার করার ঘটনা সারাদেশে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পাঠ্যবই প্রত্যাহারের ঘটনা দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম বলে জানা গেছে। শিক্ষা-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এনসিটিবি বার বার সংশোধনী দেওয়ার ঝামেলা এড়িয়ে একবারে পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভালো হয়েছে। এতে বিতর্ক কমানো গেছে। তাঁরা আরও বলছেন, এর মাধ্যমে এনসিটিবির দক্ষতার ঘাটতি ও গাফিলতি আরও প্রকট হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা নিয়ে গত বছর বছরব্যাপী যে প্রচার-প্রচারণার দরকার ছিল, তাতে ব্যাপক ঘাটতি ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেভাবে সচেতন হতে পারেননি। শিক্ষক, বই লেখক, শিক্ষার্থী সবাইকে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর সঙ্গে সেভাবে সম্পৃক্ত করে সঠিক সমন্বয় করা যায়নি। এনসিটিবি নতুন কারিকুলামে বই লেখার জন্য লেখকদেরও সেভাবে সময় দিতে পারেনি। তাড়াহুড়ো করে বই লেখা ও প্রকাশের পরিণতিতে এখন সরকারকে বিব্রত হতে হচ্ছে।
অবশ্য এনসিটিবির সম্পাদনা শাখার কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে বলেন, পাঠ্যবইয়ে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রতি বছরই থাকে, এবারও ছিল। আগে পুরোনো কারিকুলামের বই বছর বছর সংশোধন হতে হতে ভুলের পরিমাণ কমে এসেছিল। এবার নতুন কারিকুলামের নতুন লেখা বইয়ে সংগত কারণেই ভুলের পরিমাণ বেশি থেকে গেছে। তাঁরা বলেন, তবে যেসব ভুল-ত্রুটি পাঠ্যবইয়ে নেই, সেগুলোর কথা বলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিকবিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। পরের দিন জুমার নামাজের আগেই এ সিদ্ধান্ত সবাইকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বইয়ের ভুল-ত্রুটির চেয়েও এক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক’ নানা বিষয় মাথায় রেখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নির্বাচনের বছরে সরকার পাঠ্যবই নিয়ে কোনো বিতর্ক দেখতে চায় না।
অবশ্য বই প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, বইগুলো নিয়ে সারাদেশে সামগ্রিক যে আলোচনা চলছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন ছবি ও দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে বই প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই দুই বই নিয়েই বেশি সমালোচনা ও আপত্তি উঠেছিল। বই প্রত্যাহারে শিক্ষার্থীদের শিখনে কোনো ঘাটতি হবে না বলে জানান এই সদস্য।
বইয়ে কী কী সংশোধন আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনুশীলন পাঠ বই দটিতে কিছু কিছু জায়গায় আপত্তি আছে। সেগুলো আমরা সংশোধন করব। সেটি আগামী মার্চে শুরু হতে পারে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়া, গণমাধ্যমসহ অন্য সব জায়গা থেকে দেখেশুনে সেগুলো নোট নিয়েছি। এখন এসব বইয়ের লেখকদের ডেকে বিষয়টি জানানো হবে।
বই প্রত্যাহারের পর এনসিটিবি এখন কী করছে- এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বলেন, দুটি বই প্রত্যাহার ও নতুন করে কয়েকটিতে সংশোধনের সিদ্ধান্ত সব উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আমরা এখন যেসব বই সংশোধন হবে, সেগুলোর ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছি। তাদের মতামত অনুযায়ী সংশোধনী ছোট হলে আমরা তা সংশোধনী আকারে স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেব। আর বেশি সংশোধনী এলে পুরো বই পাল্টে দেওয়া হবে। আশা করছি দ্রুতই সংশোধন করা সম্ভব হবে।
এদিকে, এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী বলেছে, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের বার বার আপস শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবির মুখে অনেকটা আকস্মিকভাবেই পাঠ্যবই প্রত্যাহারের নামে কার্যত বাতিল করেছে। এছাড়া পাঠদান প্রত্যাহার নয়- শিক্ষার্থীদের কাছে বিতরণ করা সাত দিনের মধ্যে বই বাজেয়াপ্ত করা ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ করার দাবিতে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট।