পাকিস্তানে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম এখন ২৭২ রুপি। খোলা দুধের দাম প্রতি লিটার ২৫০ রুপিতে পৌঁছেছে। মুরগি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭৮০ রুপিতে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩ বিলিয়ন ডলারে। মুদ্রাস্টম্ফীতি অন্তত ৩৮ শতাংশ।
২৪ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটির এ কয়েকটি চিত্রই বলে দিচ্ছে কী ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট চলছে সেখানে। তবে এটা হঠাৎ করেই আসেনি। বেশ কিছু দিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন, যে কোনো সময় খেলাপি বা দেউলিয়া হতে পারে পাকিস্তান। এবার সেই আশঙ্কার ধোঁয়াশা দূর করলেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। তিনি দাবি করেছেন, পাকিস্তান ইতোমধ্যেই খেলাপি হয়ে গেছে। আর এ জন্য তিনি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র এবং রাজনীতিবিদসহ সবাইকে দায়ী করেছেন
শনিবার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোট শহরে একটি বেসরকারি কলেজের অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় প্রভাবশালী এই মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন যে, পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে বা খেলাপি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে বা বিপর্যয়কর পতন বা ভাঙনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। আমরা একটি দেউলিয়া দেশে বাস করছি।’
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, একটি স্থিতিশীল দেশ হওয়ার জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো অপরিহার্য। বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা গত সাত দশকে সংবিধান ও আইনের শাসনের প্রতি সম্মান না দেখানোরই ফল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ভাঙনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এত বড় অর্থনৈতিক সংকটে আর পড়েনি দেশটি। নানা সংকট থাকলেও পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল স্থিতিশীল। মাথাপিছু আয়েও এক সময় ভারতের কাছাকাছি ছিল দেশটি। এগিয়ে ছিল বাংলাদেশের চেয়ে।
সেই পাকিস্তানে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে বৈদেশিক ঋণ ৭০ শতাংশ বেড়েছে। এটা ডলারের ঘাটতিকে আরও তীব্র করেছে। অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিপুল ঋণ পরিশোধে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপকভাবে কমেছে। বর্তমানে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৩২০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দিয়ে এক মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ সম্ভব। তবে মুদ্রার রিজার্ভ এক সপ্তাহে ২৭.৬ কোটি ডলার বেড়েছে বলে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান জানিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে পাকিস্তানের রাজস্ব ঘাটতি ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। প্রথম প্রান্তিকে দেশের বাজেট ঘাটতি ছিল জিডিপির ১ শতাংশ, আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এটা ছিল শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।
সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া পাকিস্তানে মূল্যস্টম্ফীতি নতুন রেকর্ড করেছে। এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় গত সপ্তাহে মুদ্রাস্ম্ফীতি ৩৮.৪২ শতাংশে ঠেকেছে বলে সরকারি তথ্যেই জানা গেছে। দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে মূলত পেঁয়াজ, মুরগি, রান্নার তেল এবং জ্বালানির।
গত সপ্তাহে আলোচনা করতে আসা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দলটি চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে অর্থমন্ত্রী ইসহাক দার এবং প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তাদের সব শর্তে রাজি হয়েছেন। এর পরই জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়।
আইএমএফের সঙ্গে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে পাকিস্তানকে এসব করতে হয়েছে। শর্ত পূরণ করায় পাকিস্তান ১১০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে।
আইএমএফ, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। তারা অর্থনীতিতে কাঠামোগত সংস্কারের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির মান দেশটির দুর্বলতম অর্থনীতির আরেকটি সূচক। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ২৬২ রুপিতে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলেও রুপির অবমূল্যায়ন হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ‘এ সমস্যার সমাধান দেশের ভেতরেই আছে, আইএমএফের কাছে নয়।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের দামি সরকারি জমিতে যে দুটি বিলাসবহুল গলফ কোর্স আছে, তা বিক্রি করলে দেশটির এক-চতুর্থাংশ ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া চলমান সংকট মেটাতে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সরকারি ব্যয় হ্রাস করে কৃচ্ছ্র সাধনের নীতি ঘোষণা করবেন বলে জানিয়েছেন আসিফ। ভয়াবহ আর্থিক সংকট মোকাবিলায় ইতোমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএমএল-এন ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জোট সরকার। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজসহ পিএমএলের (এন) ১২ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও তিনজন প্রতিমন্ত্রী বিনা বেতনে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পাকিস্তানিরা বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু এর মধ্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে কানাডার নামি কফি ব্র্যান্ড টিম হর্টন। দেশের দুরবস্থার মধ্যেও লাহোরে এই ব্র্যান্ডের দোকার খোলার পর থেকে সেখানে পা ফেলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বক্ষণই ক্যাফের বাইরে দেখা যাচ্ছে কফির জন্য অপেক্ষমাণ জনতার দীর্ঘ সারি। এ ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে।
ইকোনমি ডট পিকের তথ্য অনুসারে, টিম হর্টন পৃথিবীর অন্যান্য শহরে নতুন দোকান খোলার পর প্রথম দিন যা ব্যবসা করেছে, লাহোরের ওই ক্যাফেতে প্রথম দিন তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে।
এ চিত্র দেখে পাকিস্তানের অনেক সচেতন নাগরিক টুইটারে দুই বিপরীতমুখী চিত্র পোস্ট করছেন। একদিকে টিম হর্টনের দোকানে উচ্চবিত্তদের সারি, অন্যদিকে আটা কিনতে আমজনতার হুড়োহুড়ি। খালিদ উমর নামের দেশটির এক নাগরিক টুইট করেছেন, ‘এটাই জিন্নাহর দুই জাতি তত্ত্ব। এটা শুধু হিন্দু-মুসলমানের বিষয় নয়, ধনী-গরিবেরও ব্যাপার, শাসক-শাসিত ও রাজা-ভিখারির বিষয়। ভারত সামন্ততন্ত্র থেকে মুক্ত হলেও পাকিস্তানে তার হাজারো রূপ আছে।’ সূত্র : দ্য ডন, ইকোনমিক টাইমস ও দ্য মিন্ট