মাত্র পাঁচ বছর আগে কেনা ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকার একটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এখন সংস্কারেই লাগছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৪৫ টাকা। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সীমিত পরিসরে এ যন্ত্রটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই সময় দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়েছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে। তখন উচ্চ দামে এসব যন্ত্র কেনা হয়েছিল। এগুলো ১০-১৫ বছর নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যাবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল।
কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, দেড় লাখ ইভিএমের ৪০ হাজার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার মেশিন ব্যবহার উপযোগী করতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। ইভিএম সরবরাহকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) বলছে, অযত্ন-অবহেলা এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না করার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান সমকালের সঙ্গে আলাপকালে একই ধরনের মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, এসব মেশিন সংরক্ষণের জন্য মাঠ পর্যায়ে ইসির পর্যাপ্ত স্থান ও জনবল ছিল না। কোনো কোনো মেশিনে উইপোকা ধরে গেছে। অনেকগুলোর কেবল নষ্ট হয়ে গেছে। আবার কোনোটির ব্যালট ইউনিটের মনিটর ভেঙে গেছে। রাকিবুল জানান, এসব মেশিনে নিয়মিত চার্জ দিয়ে রাখলেও সচল থাকত। সেটিও করা সম্ভব হয়নি। ফলে এখন সংস্কার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠ পর্যায়ের পাশাপাশি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনেও ইভিএম সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় গুদামঘর নেই। এ কারণে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হলেও তা কখনোই ইসি সচিবালয় বুঝে পায়নি। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে এগুলো বিএমটিএফের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে এনে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকেই আবার মেশিনগুলো ফেরত এনে বিএমটিএফের কাছে রাখা হয়েছে।
গত সংসদ নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়। সব মিলিয়ে গত ২০ মার্চ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকারের (সিটি, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ) ভোটসহ মোট ১ হাজার ১৫৫টি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে।
এবার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরই দেড়শ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। ইসির বক্তব্য ছিল, তাদের হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএমে ৬০ থেকে ৭০টি আসনে ভোট করা সম্ভব। দেড়শ আসনে ভোট করতে আরও ২ লাখ ইভিএম প্রয়োজন হবে। এ জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রস্তাবটি অনুমোদন না হওয়ায় বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ইসি। কিন্তু নিজেদের হাতে থাকা দেড় লাখ মেশিন ব্যবহারেও তারা আর্থিক সংকটে পড়েছে।
ব্যালটে ভোট নিতে খরচ বেশি, তাই ইভিএমের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন– এমন বক্তব্য এর আগে কমিশনের সদস্যরা দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, এটা আসলে হিসাব-নিকাশ ছাড়া বলার সুযোগ নেই। কারিগরি কমিটি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবে।
চলতি অর্থবছরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে সম্প্রতি ৬৩০ কোটি টাকা চেয়েছে ইসি। এ ছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যয় বাবদ নতুন অর্থবছরে ৩ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ না থাকায় নতুন করে অর্থ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে নির্বাচন কমিশনের অন্য খাতের বরাদ্দ কমিয়ে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া যায়। কিন্তু এভাবে ৬৩০ কোটি টাকা জোগান দেওয়া কঠিন।
বিএমটিএফের বকেয়া ১৯১ কোটি টাকা: ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ, গুদাম ভাড়া এবং মেশিন ক্রয় বাবদ বিমটিএফ এ পর্যন্ত ইসির কাছে পাবে ১৯১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওয়্যারহাউস ভাড়া বাবদ বকেয়া হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। মাসিক সাড়ে ৯৭ লাখ টাকা ভাড়ায় বিএমটিএফের গুদামে প্রায় ৬৫ হাজার ইভিএম মজুত রাখা হয়েছে। ইভিএমগুলো ২০১৮ সাল থেকেই বিএমটিএফে সংরক্ষিত থাকলেও উভয় পক্ষের আলোচনায় ভাড়া কার্যকর করা হয় ২০১৯ সাল থেকে। এই মেশিনগুলো বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা হয়। ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ পাওনা আছে ৬০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইভিএম কেনাবাবদ বকেয়া রয়েছে ৮৮ কোটি টাকা।
উচ্চ দামে কেনা: সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে এই মেশিন কেনা হয়েছিল। ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ১৭ হাজার রুপি। এর আগে ড. শামসুল হুদা কমিশনের মেয়াদে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ইসির জন্য যে ইভিএম তৈরি করেছিল, তার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা।
তবে ইসির ইভিএম সংক্রান্ত কারিগরি টিমের সদস্য এবং বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম জানান, ভারতের ইভিএমে ফ্রিঙ্গার স্ক্যানার নেই। তাই ওই মেশিনের সঙ্গে এর তুলনা করলে চলবে না। অন্যদিকে বুয়েট যে মেশিন তৈরি করেছিল, তাতেও ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে কেনা দেড় লাখ ইভিএম সংরক্ষণে ইসি যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি। তাদের প্রশিক্ষিত জনবলও ছিল না। তিনি বলেন, বিএমটিএফ এসব মেশিনের পার্টস দেশে বানানোর উদ্যোগ নিলে বুয়েটের পক্ষ থেকে তারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত ভোটার ও প্রার্থী সংখ্যা, ভোটার পরিচয় নিশ্চিত করা, ভোট গণনা, সার্ভার-সক্ষমতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের স্পেসিফিকেশনের ওপর ইভিএমের দাম নির্ভর করে। বাংলাদেশে ইভিএমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি বা হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে বা স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। ভারতের ইভিএমে এই সুবিধা নেই। তবে ভারতের ইভিএমে ভোটার ভ্যারিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সংযুক্ত আছে। এতে ভোটার তাঁর পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে পারছেন কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ইভিএমে এই সুবিধা নেই।
২০১০ সালে দেশে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের প্রচলন শুরু করে শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। ওই সময় তারা বুয়েটের কাছ থেকে ১ হাজার ২৫০টি ইভিএম কেনে। ওই কমিশন এই যন্ত্রে ভোট নিয়ে সফলও হয়। পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ২০১৫ সালে ভোট নিতে গেলে একটি মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। সেই মেশিনটি পরে আর ঠিক করতে পারেনি কমিশন। তাই ওই মেশিনগুলো নষ্ট করে নতুন করে আরও উন্নত প্রযুক্তি ইভিএম তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় রকিব কমিশন। এর পর ২০১৭ সালে কে এম নূরুল হুদার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর দেড় লাখ টাকা দরে ইভিএম কেনে বিএমটিএফ থেকে।
এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেন, ২০১৮ সালে ১৩ জন লোকবলসহ ইভিএম প্রকল্পটির অনুমোদন পায়। এতে শুধু দেড় লাখ ইভিএম ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির কেনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রতিটি ইভিএমের জন্য ১ বছর গ্যারান্টি ও ৫ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি প্রদান করা হয়। প্রকল্পে সংরক্ষণ সংক্রান্ত কোনো খাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ফলে মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা না থাকায় এসব ইভিএম প্রাথমিকভাবে জেলা, উপজেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও সরকারি স্থাপনায় রাখা হয়। এসব স্থাপনার পরিবেশ ইভিএম সংরক্ষণের জন্য সহায়ক ও উপযুক্ত ছিল না। এর ফলে মাঠ পর্যায়ে সংরক্ষিত ইভিএমগুলোর ক্ষেত্রবিশেষে বিনষ্ট হয়। বর্তমানে ইসি জেলা পর্যায়ে বাসা ভাড়া করে ইভিএম সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, এ প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন ২০২৩ সালে শেষ হবে। আগামী সংসদীয় নির্বাচন যেহেতু প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা পরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে, এ কারণে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএমটিএফ সার্বিক বিবেচনায় ইভিএম সংস্কারের প্রস্তাব ইসিকে জানিয়েছে।