প্রচণ্ড গরমে কমছে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা, দুই খাতে বেশি ক্ষতি: গবেষণা

0
177
প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত কৃষিশ্রমিক

জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত থাকে ভরা শ্রাবণ। আর শ্রাবণ মানে ভরা বর্ষা, ঝুমবৃষ্টি। আকাশজুড়ে দিনভর মেঘ। কিন্তু গরমের পর প্রশান্তির এই ঋতু এবার উল্টো আচরণ করছে। যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বলছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমছে। তাঁদের মধ্যে দুই খাতের শ্রমিক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ বছর জুলাই মাসে ছিল এযাবৎ পৃথিবীতে সবচেয়ে গরম দিনের রেকর্ড। ২০১৬ সালে বিশ্বে গড় সবচেয়ে উষ্ণ তাপমাত্রার যে রেকর্ড ছিল, এবারের তাপমাত্রা তাকে ছাড়িয়ে গেছে। এবার প্রথমবারের মতো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১৭ সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের  জলবায়ু পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপার্নিকাস জানাচ্ছে ৬ জুলাই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক শূন্য ৮।

বিশ্বে যে চরম আবহাওয়া বিরাজ করছে বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। চরম গরম আবহাওয়ার সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশের মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপরে পড়ছে।

যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত সপ্তাহে বাংলাদেশে অতি উষ্ণ তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বাংলাদেশে গরমের কারণে দুই খাতের শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক। দ্বিতীয়ত, কৃষিশ্রমিক।

গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গরমের কারণে এই দুই খাতের শ্রমিকেরা আগের চেয়ে কম কাজ করতে পারছেন। তাঁদের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। আর সামগ্রিকভাবে জাতীয় উৎপাদন কমে আসছে।

লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রানথাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ও সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিসি যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে।

শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা কমছে

গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৮০ সালের মধ্যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। আর তাতে এখানকার শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা ৪৬ শতাংশ কমে আসতে পারে। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে শিল্প ও কৃষি খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু গবেষক বজলুর রশিদ বাংলাদেশের তাপমাত্রার বদল নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি এ ব্যাপারে বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে ভরা বর্ষায় অর্থাৎ জুন-জুলাই মাসেও বৃষ্টি কমছে। ফলে ওই সময়ে গরম বাড়ছে। আর আবহাওয়ার পরিবর্তন ও প্রকৃতি ধ্বংস করায় গ্রীষ্মকাল আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে। গত বছরও জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। আর এপ্রিল ও মে মাস ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম। ফলে আমাদের এই অতি উষ্ণ গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের সঙ্গে কীভাবে খাপ খাইয়ে চলা যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে।’

লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটিতে বলা হয়েছে,  তাপমাত্রা যদি তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে আর ওই পরিস্থিতির সঙ্গে যদি খাপ খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমে যাবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির পরিমাণ ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হবে।

চলতি বছরের জুন মাসে বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদি এবং উষ্ণ তাপপ্রবাহ ছিল বলছে ওই গবেষণা। সে সময় দেশের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল।

বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৩৭ শতাংশ কৃষিতে ও ২২ শতাংশ শিল্পকারখানায়। এই শ্রমিকেরা সরাসরি ওই তাপপ্রবাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেছে ওই গবেষণা।

শরীর ও মনের ওপর গরমের প্রভাব

গবেষণাটিতে বলা হয়, অতিরিক্ত গরমের কারণে মানুষের শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিটস্ট্রোক বেড়ে যায়, এতে অনেকের মৃত্যুও হয়। মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতাও কমে আসে। ফলে সামগ্রিকভাবে তাঁদের কাজ করার ক্ষমতা কমে আসে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূল ও বন্যাপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষ শহরে চলে আসছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোয় এ কারণে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এতে শহরের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে হিট আইল্যান্ড বা তাপীয় দ্বীপ এলাকা তৈরি হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে পুরো শহর আরও বেশি বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।
‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা’ থেকে চলতি মাসে ঢাকার সবুজ এলাকা নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছে। ‘বৃক্ষনিধন ও তার পরিবেশগত প্রভাব: আমাদের করণীয়’ ওই গবেষণায় বলা হয়, গত তিন দশকে ঢাকার সবুজ ও ফাঁকা জায়গা কমেছে প্রায় ২৩ বর্গকিলোমিটার। এই মহানগরে ২০ শতাংশ সবুজ এলাকার প্রয়োজন থাকলেও আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম। এতে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ঢাকায় তাপমাত্রা বেশি থাকে গড়ে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

লিডসের গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, ঢাকায় ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে ঢাকার সামগ্রিকভাবে তাপমাত্রা বেড়েছে। ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে শহরের কেন্দ্রীয় এলাকার তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকছে।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট এর বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, অতি উষ্ণ তাপমাত্রার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো বাংলাদেশে স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে তাপপ্রবাহ সরাসরি এখানকার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ধরে রাখতে হলে এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শহরে গাছপালা ও জলাভূমি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

রাতে কাজ, বিরতি ১৫ মিনিট

গবেষণাটিতে পরামর্শ হিসেবে শ্রমিকদের জন্য দিনের বেলা কাজ না করে রাতের বেলা কর্মসময় ঠিক করার জন্য বলা হয়। প্রতি ঘণ্টায় ১৫ মিনিট করে কাজের বিরতি দিলে একজন মানুষের কর্মশক্তি বাড়ে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক দেশে এভাবে নিশ্বাস ও বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে তাঁদের শরীর সুস্থ থাকে। গরমের কারণে কর্মদক্ষতা কমে না। একই সঙ্গে কাজের জায়গা বা কারখানাগুলোতে বাতাস প্রবাসের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তা যাতে অতিরিক্ত উষ্ণ না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.