প্রকাশ্যে একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসী, অশান্ত ঢাকার অপরাধজগৎ

রাজধানীতে টার্গেট কিলিংয়ের শঙ্কা

0
100
তারিক সাঈদ মামুন ও সানজিদুল ইমন

আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে রাজধানীর অপরাধজগৎ। দেশ-বিদেশে যেসব সন্ত্রাসী পলাতক ছিল তাদের মধ্যে অনেককে দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্যে। কয়েকজন জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে নতুন গ্রুপ তৈরি করছে। এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন মেরূকরণ তৈরি হয়েছে। কয়েকজন কারাগারে বসেই কলকাঠি নাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে আধিপত্য, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টার্গেট কিলিংয়ের মতো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনের ওপর গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে। এর পেছনে কারাবন্দি আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের হাত রয়েছে বলে জানায় একাধিক গোয়েন্দা সূত্র।

মামুন সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই শহীদ সাঈদ আহমেদ টিপু ও চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি। সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় ২৬ বছর জেল খেটে তিন মাস আগে মামুন জামিনে মুক্তি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর থেকেই মামুনকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ইমন। হত্যা অভিযান ব্যর্থ হলেও এ ঘটনার জেরে এখন পাল্টা হামলার আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। এমনকি চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেই মামুন তার ওপর হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন পর রাজধানীতে প্রকাশ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা দেখা গেছে। এর আগে ২০২২ সালের মার্চে সন্ত্রাসীদের মধ্যে স্বার্থের বিরোধের জেরে খুন হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিক ও জিসানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, টিপু খুনের মধ্য দিয়ে মতিঝিল এলাকা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি একটি বার্তা দিতে চেয়েছে সন্ত্রাসীরা। তাদের নামে চাঁদাবাজি নির্বিঘ্ন করতে টিপুকে হত্যার মিশনে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যুক্ত হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি পুরান ঢাকায় জমি ব্যবসায়ী এখলাসকে হত্যা করে একটি গ্রুপ। ওই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন এশিয়ান লেদার ও আইয়ুব ব্রাদার্স ট্যানারির মালিক মনির হোসেন। গোয়েন্দারা বলছেন, কারাবন্দি ইমনকে নিয়মিত চাঁদা দিতেন মনির।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ঢাকার অপরাধজগৎ এখন যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে অন্যতম ইমন। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী, মঞ্জুরুল ইসলাম অশ্রু, অধ্যাপক আফতাব, করিম হত্যাসহ অন্তত ৩০টি মামলা রয়েছে ইমনের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরে সে কারাবন্দি। মূলত ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগে তার নিয়ন্ত্রণ। কারাগারে থাকলেও অপরাধ জগতে তার প্রভাব কমেনি। অনেক দিন ধরে ইমনের সঙ্গে কারাগারে ছিল মামুন। তবে যখন মামুন মামলায় জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই ইমনের সঙ্গে তার টানাপোড়েন শুরু হয়।

ইমনের ধারণা, বাইরে গিয়ে নিজে গ্রুপ গোছাতে শুরু করবে মামুন। এ ছাড়া কারাবন্দি আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের সঙ্গে মামুনের গোপন সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশ্বাস ইমনের। পিচ্চি হেলাল আর মামুনের মধ্যে রয়েছে পুরোনো বিরোধ। এর জেরেই গত সোমবার মামুনের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পিচ্চি হেলাল কারাগারে বসেই মোহাম্মদপুর নিয়ন্ত্রণ করছে।

রাজধানীর পপুলার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ভুবন চন্দ্র শীল। হাসপাতালের সিঁড়িতে দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে স্ত্রী ও সন্তানের। বুধবারের

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাং বাবুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসী তালিকায় নাম ওঠে ইমনের। এই মামলার প্রধান আসামি হলেও ১৯৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে একাধিক প্রভাবশালীর চাপে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বাধ্য হয়। পাং বাবু হত্যার পরপরই শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন, হেলাল ও জোসেফকে নিয়ে বাহিনী গড়ে তোলে ইমন। পরে ধানমন্ডি এলাকায় গালকাটা জব্বার নামে একজনকে হত্যা করে অপরাধ জগতে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে। এর পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মামুনকে নিয়ে গড়ে তোলে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। চাঁদাবাজি, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তারা। ১৯৯৬ সালের দিকে ইমন বিয়ে করে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী টিটনের বোন শাহনাজ পারভীন লিনাকে। একটি সূত্র জানায়, টিটনও সম্প্রতি জামিন পেয়েছে। তিন দিন আগে জামিনে বের হয় এই গ্রুপের আরেক সন্ত্রাসী রসু। সে ‘কিলার রসু’ নামে পরিচিত। মামুন-টিটনকে ঢাকায় প্রকাশ্যে দেখে অনেকেই বিস্মিত হন।

১৯৯৮ সালে বনানী ট্রাম্পস ক্লাবে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যার পর ডিবি পুলিশ ইমনকে গ্রেপ্তার করে। কয়েক মাস কারাগারের থাকার পর ছাড়া পেয়ে ইমন ভারতে পালিয়ে যায়। নাম পাল্টে ভারতে আত্মগোপন করে সে। এর পর একবার কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। জামিন পেয়ে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ইমন আবার দেশে ফেরে। তবে ২০০৪ সালে বন্দুকযুদ্ধ আতঙ্কে ফের ইমন ভারতে পালিয়ে যায়। ২০০৭ সালের শেষদিকে সিআইডির একটি দল ইমন, তাজ, ইব্রাহিম, লম্বু সেলিমসহ ৭ সন্ত্রাসীকে দেশে ফেরত আনে। এর পর থেকেই ইমন কারাগারে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যাংককে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী উল্লাহ নবী ও পিচ্চি হেলাল। এ দুই এলাকার বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা যায় তাদের কাছে। রামপুরা, গুলশান, বাড্ডাসহ রাজধানীর একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রক জিসান। দুবাইয়ে পলাতক জিসানের কিলার বাহিনীর সদস্যরা এখন সক্রিয়। তার সঙ্গে সমঝোতা করেই ভারতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ও মোল্লা মাসুদ গণপূর্ত, ক্রীড়া পরিষদ, রাজউক ও রেলওয়ের দরপত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া সম্প্রতি আরেক সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে গোপীবাগ এলাকায় ফিরেছে। একইভাবে মগবাজারের দুই সন্ত্রাসীকে কিছুদিন ধরে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে ছিল।

এদিকে মামুনের ওপর হামলার সময় সন্ত্রাসীদের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হন পথচারী মোটরসাইকেল আরোহী আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল। টার্গেট মিস হওয়ায় আরেক পথচারী আরিফুল হক ইমনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এর মধ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ ভুবন বর্তমানে লাইফ সাপোর্টে আছেন। ওই ঘটনায় গতকাল বুধবার অজ্ঞাতদের আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেছেন ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীল। যদিও হামলায় জড়িত কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে হামলায় সরাসরি জড়িত এমন একজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানান গোয়েন্দারা। এ ছাড়া ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এতে উঠে এসেছে, অন্তত ৬টি মোটরসাইকেলে ৮/৯ জন মামুনকে অনুসরণ করছিল। সোমবার রাতে মগবাজারের একটি বার থেকে বের হওয়ার পর মামুনের পিছু নেয় তারা। যদিও প্রথমে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, ৪টি মোটরসাইকেলে মামুনকে বহনকারী গাড়ি অনুসরণ করছিল সন্ত্রাসীরা।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, মামুনের ওপর হামলার ঘটনায় কারা জড়িত, বের করার চেষ্টা চলছে। পুলিশের একাধিক টিম অভিযানে রয়েছে।

সাহাদাত হোসেন পরশ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.