কারাবন্দি নেতাকর্মীর ‘যন্ত্রণার জীবন’

0
73

আস্থা, অহনা আর আঞ্জুম– যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের তিন কন্যা। বাবাকে দেখেন না তা-ও সাত মাস। বাবার প্রতীক্ষায় প্রতিক্ষণ নীরবে কাঁদেন। গত মার্চ থেকে নিরব কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। শুরুর এক মাস সাধারণ সেলে থাকলেও এর পর ফাঁসির আসামি না হয়েও তাঁকে ঢুকতে হয় কনডেম সেলে। সেখানে তাঁর সঙ্গে আচরণটা করা হচ্ছে ফাঁসির আসামির মতোই। কারা অভ্যন্তরেও কেউ (বন্দি বিএনপি নেতাকর্মী) তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না। এসব অভিযোগ সাইফুল আলম নিরবের স্ত্রী মাহবুবা খানমের।

মাহবুবার ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে নিরব অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য আদালতে আবেদনও করেছিলেন তিনি। তবে কোনো সুযোগই মিলছে না। ভয়ংকর কষ্টের মধ্যে রাখা হয়েছে নিরবকে। ১৫ দিন পরপর তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায়। তিন মেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। বাবার কষ্ট সহ্য করতে পারবে না, তাই কারাগারে দেখা করতে গেলেও মেয়েদের নিতে পারেন না।

এদিকে, ফাঁসির আসামি না হয়েও ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লারও জায়গা হয়েছে কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে। গত অক্টোবরে এক মামলায় আদালতে হাজির করা হলে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি জানান, সেখানে তিনি ভালো নেই। তাঁকে যে অবস্থায় রাখা হয়েছে, তাতে সেখানে তিনি মারাও যেতে পারেন। পুলিশ হেফাজতে আদালতপাড়ায় এমন শঙ্কার কথা বলতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ তাঁর মুখ চেপে ধরে। এ রকম একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। গণঅধিকার পরিষদের (নুর) উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফ অভিযোগ করেন, আটকের পর কয়েকটি মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। অসুস্থ হলেও তাঁকে তেমন চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।

‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’– বাংলাদেশ কারাগারের স্লোগান। কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা; যথাযথভাবে তাদের বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা এবং আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ নিশ্চিত করার বিধান রয়েছে। তবে বিএনপির অভিযোগ, দেশের কারাগারগুলোতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর চলছে এর উল্টোটা।

কারাবন্দি বিএনপি নেতাকর্মীর স্বজনরা জানান, কারাগারে বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে যে আচরণ করা হয় যেন তারা সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধী।
গত ১৮ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসএম হল ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি হাবিবুল বাশার। তিনি অভিযোগ করেন, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনার আগেই কাশিমপুর-২ এবং কেরানীগঞ্জ কারাগারের মেঘনা ও শাপলা ভবন খালি করা হয় বিএনপি নেতাকর্মীর জন্য। এখানে সবাইকে লকআপে রাখা হয়। বন্দি আইনের কোনো সুযোগই দেওয়া হয় না। এমনকি চিকিৎসাসেবা নিতে গেলেও আগে পরিচয় জানতে চায়। বিএনপি পরিচয় পেলেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অকথ্য ব্যবহার করা হয়।

অভিন্ন বক্তব্য জামিনে মুক্তি পাওয়া ফেনী জেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা সুমন আহসানের। তিনি জানান, ঘোরাফেরা থেকে শুরু করে প্রতি ক্ষেত্রেই তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। কারাগারের ভেতর কেউ কারও সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। এখানে জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও কোনো সম্মান নেই।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, পুলিশ ও কারা নির্যাতনে গত এক মাসে দলের তিন নেতাকর্মী মারা গেছেন। সেখানে ন্যূনতম চিকিৎসা দেওয়া হয় না। একেবারে অন্তিম সময়ে অসুস্থ নেতাকর্মীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসা অবহেলার কারণেই গোলাপুর রহমান, ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল ও আসাদুজ্জামান হীরা মারা যান।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ছোট ছেলে সৈয়দ আরাফাত আবদুল্লাহ অন্তর বলেন, ‘সম্প্রতি আমার বাবার কিডনি অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে মেডিকেলের তোশক ও কোলবালিশ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। এসব কাগজপত্র আর মেডিকেল তোশক-বালিশ তাঁকে দিতে দিচ্ছে না। ১৫ দিন ঘুরিয়ে সেসব ফেরত দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় বাবা জামিন না পেলে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

গত মার্চে আটক করা হয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্নাকে। আটকের সময় তাঁর নামে তেমন কোনো মামলা না থাকলেও এখন একের পর এক মামলা দিয়ে কারাজীবন লম্বা করা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের ‘নো অ্যারেস্ট, নো হ্যারেস’ নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। শারীরিকভাবে অসুস্থ এ নেতাকেও দিনের বেশির ভাগ সময় লকআপে রাখা হচ্ছে।

বিএনপির বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী শামসুন্নাহার অভিযোগ করেন, আগস্টের শুরুতে সালাহউদ্দিন আহমেদ গ্রেপ্তার হন। নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে ডিভিশন না দিয়ে সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে রাখা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশনারও দুই মাস পর তাঁকে ডিভিশন দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। গত ৭ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। তবে তাঁর চিকিৎসা নিয়েও গড়িমসি শুরু করে তারা। অসুস্থতার চার ঘণ্টা পর তাঁকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার কারাগারে নেওয়া হয়। গত ৪ অক্টোবর একই কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে এবার তাঁকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাঁকে আইসিইউতে নেওয়া হয়।
গত ১৭ অক্টোবর বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। আদালত ঘুরে এক সপ্তাহ পর গত ২৩ অক্টোবর তাঁর ভাগ্যে ডিভিশন জোটে।

কারাবন্দি নেতাদের স্বজনরা জানান, কারাগারে এখন দুই নিয়ম। নেতাকর্মীর ক্ষেত্রে ১৫ দিনের আগে কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। আবার নির্ধারিত দিনে দেখা করতে গেলেও নানা হয়রানির মুখে পড়তে হয়। তবে অন্য বন্দিদের জন্য এ ধরনের কোনো নিয়ম মানতে হয় না।

শুধু কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার নয়; কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারেও বঞ্চনার শিকার বিএনপি নেতাকর্মীরা। এখানে বেশির ভাগ নেতাকর্মীর সেলের সামনে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে, যাতে কেউ তাদের সঙ্গে দেখা ও কথা বলতে না পারে। এই কারাগারে বন্দি আছেন যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর। তাঁর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা লাভলী বলেন, ‘কারা নির্যাতনের মধ্যে এখন চলছে প্রতিদিন আদালতে হাজিরা। কাশিমপুর কারাগার থেকে তিন-চার ঘণ্টা ধরে প্রিজনভ্যানে করে যেতে-আসতে হয়। শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় খুব বেশি কষ্ট সইতে হচ্ছে তাঁকে। এসব কার কাছে বলব? আমাদের আছে আল্লাহ। শুধু তাঁর কাছেই বলি।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আতাউর রহমান ঢালী, হাবিবুর রহমান হাবিব, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমি, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবীর খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ, ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, নির্বাহী সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি, আবু বক্কর সিদ্দিক, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস মৃধা, তানভীর আহমেদ রবিন, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক সহসভাপতি আলী আকবর চুন্নু, ইউসুফ বিন জলিল কালু, যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহীন, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আজিজুর রহমান মোসাব্বিরসহ সারাদেশে ২১ হাজারের বেশি নেতাকর্মী কারাবন্দি রয়েছেন।

দলটির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা অভিযোগ করে বলেন, বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানের পর রাখা হয় সবচেয়ে খারাপ সেলে। দিনরাত তাদের লকআপে রাখা হয়।

কেরানীগঞ্জ কারাগারের শাপলা ও মেঘনা বিল্ডিংয়ে বেশির ভাগ বিএনপি নেতাকর্মীকে দিনরাত আটক রাখা হয়। সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে কারাগারে শুধু তাদেরই গতিবিধি নজরদারি করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, দিনের বেলায় কারাগারের প্রাঙ্গণে বিচরণ করার বিধান আছে, অথচ বিএনপি নেতাকর্মীর ভাগ্যে সেই সুযোগটুকু এখন নেই।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশের কারাগারগুলো বাস্তবিক অর্থেই এখন ভয়াবহ নিপীড়ন-নির্যাতনের আয়নাঘর। আইজি প্রিজন হচ্ছেন এ ফ্যাসিবাদের এক বিশ্বস্ত সহচর। বিএনপি নেতাকর্মী যাতে নিদারুণ কষ্ট ও দুর্দশার মধ্যে দিনযাপন করেন, সেটার দেখাশোনাই এখন তাঁর প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, কারাগারে বিএনপি নেতাকর্মীকে পরিকল্পিতভাবে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে শোষণ করা হচ্ছে। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেল বিপজ্জনক জঙ্গি অপরাধীদের জন্য। সেখানেই বিএনপি নেতাকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ছাত্রদের গাদাগাদি করে রাখা হয়।

এ বিষয়ে কারা উপমহাপরিদর্শক এ কে এম ফজলুল হক বলেন, বিএনপি নেতারা যে অভিযোগ করেছেন, তা ঠিক নয়। কারাগারে কাউকে নির্যাতন করা হয় না। তবে এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় যতটুকু সম্ভব সেবা দেওয়া হয়। যখন সম্ভব হয় না, তখন বাইরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কনডেম সেলের অভিযোগটিও সত্য নয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.