মালি থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী প্রত্যাহার কেন

0
156
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা ২০১৯ সালে মালির একটি প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করেন

গত ৩ জুলাই আফ্রিকার দেশ মালি থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে তিন দশক ধরে অংশগ্রহণ করছে বাংলাদেশ। মালিতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার বৃহত্তম দলটিও ছিল বাংলাদেশের। তাই এই ঘোষণার পর্যায়টি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ শুরু বাংলাদেশ। এরপর থেকে দেশের জন্য গর্ব ও মর্যাদা বয়ে আনেন শান্তিরক্ষীরা। এ পর্যন্ত এক লাখ ৮৮ হাজার ৫৫৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিশ্বের ৪০টি দেশে জাতিসংঘের ৬৩টি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছেন। দায়িত্ব পালনকালে প্রাণ দিয়েছেন ১৬৭ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী।

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা তাদের পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা, সাহসিকতা ও মানবিকতার জন্য প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। জাতিসংঘের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ একদিকে জাতীয় মর্যাদার বিষয়, অন্যদিকে এর আর্থিক ও রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সুফলও রয়েছে। বাংলাদেশের ‘উদীয়মান শক্তির’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জাতিসংঘের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। ত্বরিত ও উৎসাহী অংশগ্রহণ ‘জাতিসংঘের মডেল সদস্য’ হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সাহায্য করেছে।

মালির সরকারের অনুরোধে ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল মালিতে জাতিসংঘের বহুমাত্রিক সমন্বিত স্থিতিশীলতা মিশন (এমআইএনইউএসএমএ) শুরু করে নিরাপত্তা পরিষদ। ২০১২ সাল থেকে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটি বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, জাতিগত সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিদেশি হস্তক্ষেপের সম্মুখীন হয়। দেশটির সরকার দেশের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে মালিতে শান্তিরক্ষী সেনা মোতায়েনের আগেই দেশটিতে ফরাসি, আফ্রিকান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সৈন্য মোতায়েন করা হয়।

মালিতে জাতিসংঘের বহুমাত্রিক সমন্বিত স্থিতিশীলতা মিশনটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান। এই মিশনে জাতিসংঘের ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি খরচ হয়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন ৩০৯ জন শান্তিরক্ষী।

বাংলাদেশ প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ এই মিশনে সেনা পাঠাতে জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। গত মে মাস পর্যন্ত এক হাজার ৩৩১ জন সেনাসদস্য, ৪৭ জন অফিসার ও ২৮২ জন পুলিশ সদস্য বাংলাদেশ থেকে এই মিশনে শান্তি যোগ দেন। বাংলাদেশি এই দলটি মালিতে শান্তিরক্ষীর দিক থেকে সবচেয়ে বড় ছিল।

মালিতে শান্তিরক্ষার প্রথাগত কাজের (যেমন- ঘাঁটি সুরক্ষা, টহল, সামরিক পর্যবেক্ষণ ও যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখা) পাশাপাশি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা সেনাবহর পাহারা দিয়েছেন। এছাড়া মালির মানুষকে মানবিক সহায়তা ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে তাদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে বেসামরিক-সামরিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ স্থাপন করেছেন তারা।

বহুমাত্রিক সমন্বিত স্থিতিশীলতা মিশনে অংশ নেওয়া অন্যান্য দেশের দল, জাতিসংঘ ও স্থানীয় জনগণ মালিতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব, কর্তব্যপরায়ণতা, মানবিকতা ও কঠোর শৃঙ্খলার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বারবার পুরস্কৃত হয়েছেন। ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল ওই মিশনে ১৩৯ জন বাংলাদেশি পুলিশ সদস্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা পদক পান। ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১৪০ জন বাংলাদেশি পুলিশ সদস্য শান্তিরক্ষা পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০২২-২০২১ সালে ৩২৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী জাতিসংঘ পদক পেয়েছিলেন।  মালিতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা স্থাপন করেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

তবে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা মিশনে প্রশংসিত হলেও মালির সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছিল। ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানে মালির সরকার উৎখাত করে বামাকোতে সেনা-নিয়ন্ত্রিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। ২০২১ সালের ২৪ মে আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তী সরকার উৎখাত করে আরেকটি নতুন সেনা-নিয়ন্ত্রিত সরকার গঠিত হয়। এদিকে, দেশে মোতায়েন মিনুসমা ও ইউরোপীয় সেনা সম্পর্কে বামাকোর দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে।

মালির সরকার ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাশিয়ান ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী নিয়োগ করে। বামাকোর এই মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ২০২২ সালের জুন ও আগস্টে মালি থেকে ইউরোপীয় ও ফরাসি সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়।

একই সময়ে, মালির সরকার জাতিসংঘের বহুমাত্রিক সমন্বিত স্থিতিশীলতা মিশনের ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে মালি সরকার ‘ভাড়াটে’ তকমা দিয়ে ৪৯ জন আইভোরিয়ান সৈন্যকে বামাকোতে আসার সময় আটক করে। তবে আইভোরিয়ান সরকার বলেছিল আটক আইভোরিয়ান সৈন্যরা জাতিসংঘের মিশনে গেছে।

জাতিসংঘের মিশন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ২০২২ সাল থেকে হাজার হাজার মালিয়ান নাগরিক বিক্ষোভ করেন। গত ১৬ জুন মালি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘকে শান্তিরক্ষীর প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী কোনো দেশের ভূখণ্ডে ওই দেশের সরকারের প্রকাশ্য অনুমতি ছাড়া কোনো শান্তি অভিযান পরিচালনা করা যায় না। তাই মালিয়ান সরকারের অনুরোধ না মেনে জাতিসংঘের আর কোনো উপায় ছিল না।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গত ৩০ জুন বহুমাত্রিক সমন্বিত স্থিতিশীলতা মিশন (এমআইএনইউএসএমএ) বাতিল করার পক্ষে ভোট দেয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের আগামী বছরের ১ জানুয়ারির মধ্যে মালি থেকে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করার কথা রয়েছে। এর অংশ হিসেবেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ছাড়া ইতোমধ্যে জার্মানিও মালি থেকে তাদের শান্তিরক্ষী প্রত্যাহার শুরু করেছে।

মালি থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী প্রত্যাহারকে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘এক ধরনের শাস্তি’ বলে উল্লেখ করতে চাইছেন। এই ব্যাখ্যা বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেশের জাতীয় ভাবমূর্তি ও বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। বেশিরভাগ বাংলাদেশি মালিতে জাতিসংঘের শান্তি অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না। ফলে মালি থেকে বাংলাদেশি সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে (এ ধরনের প্রোপাগান্ডায়) তাদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে।

এটি মনে রাখা দরকার যে, মালিতে জাতিসংঘের এই মিশন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মিশনের একটি। ১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘের মিশনে অংশ নিয়ে যে ১৬৭ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী প্রাণ দিয়েছেন তাদের মধ্যে মালিতেই নিহত হয়েছেন ১৬ জন। নিহতের হারে এটি ৯.৫৮ শতাংশ। মালির বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই প্রাণহানির জন্য দায়ী। এখন যেহেতু মালিয়ান সরকারও মিশন আর চায় না, তাই দেশটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে মালি থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহার একটি বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত।

এ আলোচনা থেকে উপসংহারে সংক্ষেপে তিনটি কথা বলে যেতে পারে।

প্রথমত, মালিতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, কঠোর পরিশ্রম ও মানবিকতার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। সেটি জাতিসংঘ ও মালিয়ান কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দেশটির সাধারণ নাগরিকরাও স্বীকার করেন।

দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মালিতে জাতিসংঘের কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশিসহ জাতিসংঘের সকল শান্তিরক্ষীদের দেশটি থেকে প্রত্যাহারের কথা রয়েছে।

তৃতীয়ত, মালি থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহারের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি বাংলাদেশের ওপর কোনো ধরনের ‘শাস্তি’ও নয়। বরং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষাপ্রধান জ্যঁ-পিয়ের ল্যাক্রোইক্সের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর ইঙ্গিত করছে, জাতিসংঘ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে আরও শান্তিরক্ষী নিয়োগ করবে।

তাই মালি থেকে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রত্যাহারের ঘটনাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। বরং মালিতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি ও সম্মানিত জানানো উচিত।

মো. হিমেল রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের নিরাপত্তা অধ্যয়ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর। আন্তর্জাতিক ও কৌশলগত বিষয়ের বিশ্লেষক। সাউথ এশিয়ান ভয়েসেস ও দ্য জিওপলিটিক্সসহ দেশি-বিদেশি নানা প্ল্যাটফর্মে তার নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। 

দ্য জিওপলিটিক্স থেকে ভাষান্তর করেছেন হাসনাত কাদীর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.