পিলখানা ট্রাজেডির ১৫ বছর, বিচারের শেষ দেখা বাকি এখনও

0
95
পিলখানা ট্রাজেডির ১৫ বছর

আজ রোববার, ২৫ ফেব্রুয়ারি। ২০০৯ সালের এই তারিখে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়েছিল দেশ। বিভিন্ন জায়গায় একযোগে বিদ্রোহ করে বসেন তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা। নরকে পরিণত হয় রাজধানীর বিডিআর সদর দপ্তর। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয় এ বিদ্রোহে। তাদের মধ্যে আছেন তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদও।

স্বাধীন বাংলাদেশে নৃশংসতম ঘটনা বলে বর্ণনা করা হয় সেদিনের বিডিআর বিদ্রোহকে। নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি কোনও মামলার। আপিল বিভাগে ঝুলে আছে হত্যা মামলার বিচার। হাইকোর্টের রায়ের পর ছয় বছর হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শুনানি হয়নি সর্বোচ্চ আদালতে। আর ২০১১ সালে শুরু হওয়া বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে ঢাকার আদালতে।

তবে চলতি বছরের মধ্যে হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু হতে পারে বলে আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামিপক্ষের প্রত্যাশা, আপিল বিভাগে বিচারক বাড়িয়ে আলাদা বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা করা হবে।

কী ঘটেছিল ১৫ বছর আগের এই দিনে

সকাল ৯টা ২ মিনিট। বার্ষিক দরবার চলছিল তৎকালীন বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) বাহিনীর। শুরুতেই উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন বেশ কয়েকজন বিডিআর জওয়ান। তাদের বক্তব্যের ভাষা ছিল ঝাঁঝালো। দাবি করেন সেনা কর্মকর্তাদের মতো সমান অধিকার। এরপরই বক্তব্য রাখেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর শাকিল আহমেদ। উত্তপ্ত দরবারের পরিবেশ।

৯ টা ২৭ মিনিট। হঠাৎ দরবার হলে ঢুকে পড়েন একদল বিদ্রোহী সৈনিক। তাদেরই একজন বন্দুক তাক করেন মেজর শাকিলের বুকে। সূচনা হয় ইতিহাসের সেই নৃশংসতম ঘটনার। সেনা কর্মকর্তাদের উপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিদ্রোহী সৈনিকরা। কর্মকর্তাদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হন না বিদ্রোহী জওয়ানরা, জিম্মি করে ফেলেন কর্মকর্তাদের পরিবারগুলোকে। পুরো পিলখানায় সৃষ্টি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকেন বিদ্রোহীরা।

দরবার হল ও এর আশপাশের এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের উপর গুলি করতে থাকেন তারা। একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ৩৬ ঘণ্টা পর এ অবসান হয় বিদ্রোহের। এক রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত হয় পিলখানা। পরে ভেতরে আবিষ্কৃত হয় গণকবরও। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার মরদেহ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা ছাড়াও নিহত হন এক সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচ বেসামরিক ব্যক্তি।

বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন ও ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরপর আসামিদের অনেকেই আপিল বিভাগে আপিল করেন, যার শুনানি এখনো শুরু হয়নি। আর বিস্ফোরক মামলাটির বিচার এখনো চলছে ঢাকার নিম্ন আদালতে।

মামলা ও বিচারকার্য

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা হিসেবে পরিচিত এটি। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়।

হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা বেড়ে হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড, ২৭৮ জনকে খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় অব্যাহতি দেওয়া হয় তাদেরকে।

আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেন সুপ্রিম কোর্ট।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের উপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়।

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (তৎকালীন বিডিআর) সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয় ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়।

এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দুজন আসামির মৃত্যু হয়েছে এবং ১২ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।

বিডিআর পুনর্গঠন ও বিজিবির আত্মপ্রকাশ

দেশের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এ বিদ্রোহের ঘটনায় সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায় বিডিআরের। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। পরিবর্তন করা হয় বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো। পরিবর্তন করা হয় তাদের আইনও। বিডিআরের নতুন নাম হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

জাতীয় সংসদে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর পাস হয় ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন, ২০১০’। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি বাহিনীর সদর দপ্তরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নতুন পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন এবং মনোগ্রাম উন্মোচন করেন। এর মধ্যদিয়ে শুরু হয় এ বাহিনীর নতুন পথচলা।

দিনটিকে ঘিরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর থেকে জানানো হয়েছে, নিহত সেনা সদস্যদের স্মরণে শাহাদাতবার্ষিকী হিসেবে রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে সেনাবাহিনী। বিদ্রোহে নিহত সেনা সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এছাড়া দিনটির স্মরণে রোববার ও সোমবার (২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি) নানা কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে বিজিবির।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.