বিশ্বজুড়ে যেভাবে কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে

0
159
জানুয়ারিতেই সারা বিশ্বে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান থেকে এক লাখের বেশি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।ফাইল ছবি: রয়টার্স

ই-মেইল ও জুমে গণছাঁটাইয়ের বার্তা

প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের ছাঁটাইয়ের খবর নানা উপায়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মী হঠাৎ আসা একটি গণ–ই-মেইলের মাধ্যমে তাঁদের চাকরি হারানোর খবর পেয়েছেন। অনেকে অফিসে গিয়ে দেখেছেন দরজায় তাঁদের কার্ডের আর অ্যাকসেস নেই, কেউ কেউ আবার অফিসে ঢুকে দেখছেন তাঁদের ল্যাপটপ ও মেসেজিং চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ থেকেই তাঁরা নিশ্চিত বুঝতে পারছেন, তাঁদের আর চাকরি নেই।

জাকারবার্গ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বছরে মোট ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার নিরাপত্তা ভাতা পাবেন। আগে এর পরিমাণ ছিল ৪০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে নিরাপত্তা ভাতা বাড়ানো হয়েছে ১ কোটি ডলার।

গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো ভিডিও কলের মাধ্যমে কর্মীদের চাকরি হারানোর বার্তা দিচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জুম ভিডিও কলে মার্কিন মর্টগেজ কোম্পানি বেটার একসঙ্গে ৯০০ কর্মীকে ছাঁটাই করেছিল।

কর্মী ছাঁটাইয়ের একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকলেও প্রতিষ্ঠানপ্রধান সে প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বেটারের সিইও বিশাল গর্গ বলেছেন, ‘আপনি যদি এই ভিডিও কলে থাকেন, তাহলে আপনি দুর্ভাগ্যজনক একটি পক্ষের সদস্য। এই কলের মাধ্যমে আপনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অবিলম্বে এ নির্দেশ কার্যকর হবে।’ কোনো কোনো সিইও আবার কর্মীদের কাছে ছাঁটাইয়ের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে কোনো কোনো কর্মীর দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে সবাই একই যে সুর ব্যবহার করেছেন, তা হলো—প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা নেই, অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ।

পদ্ধতি ও বার্তা যা–ই হোক না কেন, হোম অফিসের উত্থান ও পরবর্তী সময়ে ভার্চ্যুয়াল ছাঁটাই প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে একটি আলাদা উপাদান যুক্ত করেছে। এটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সুযোগ নিলে তার অসুবিধাটাও নিতে হবে। তবে এরপরও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মী ছাঁটাই করার নানা উপায় আছে। অনেক সহজভাবে ‘সহানুভূতিশীল’ হয়েও কর্মী ছাঁটাই করা যায়।

কর্মীদের আগে থেকেই জানাতে হবে যে কবে নাগাদ ছাঁটাইপ্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এতে ছাঁটাই হওয়ার আগেই কর্মীরা বিকল্প কাজের সন্ধান করতে পারেন।

ছবি: রয়টার্স
কর্মীদের আগে থেকেই জানাতে হবে যে কবে নাগাদ ছাঁটাইপ্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এতে ছাঁটাই হওয়ার আগেই কর্মীরা বিকল্প কাজের সন্ধান করতে পারেন।

লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সাংগঠনিক আচরণ এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক জোনাথন বুথ বলেছেন, ই-মেইল বার্তায় কর্মীদের ছাঁটাই করা উচিত নয়—এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সাধারণত একমত হবেন। দ্রুত ও হঠাৎ এমন ই-মেইল কর্মীদের অনেক বিভ্রান্ত করে দেয়। তাঁদের এ বার্তা দেয় যে প্রতিষ্ঠানপ্রধান কর্মীদের সামনে অপরাধীর মতো মুখ দেখাতে পারছেন না, লুকিয়ে আছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিয়োগকর্তারা কর্মীদের তাঁদের পরিস্থিতি বোঝাতে, কর্মীদের কিছুটা নিরাপদ বোধ করাতে সহায়তা করা উচিত।’

কর্মীকে কেন ছাঁটাই করা হলো, এ বিষয়ে ওই কর্মী অন্ধকারে থাকেন। এতে তিনি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ওপর অনেক বেশি বিরক্ত হন। বৈশ্বিক মার্কেট রিসার্চ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য হ্যারিস পোল এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি ইনটু ২০১৯ সালে লেঅফ অ্যাংজাইটি নিয়ে ২ হাজার ২৪ জন কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ বলেছেন, কেন ছাঁটাই হয়েছেন—এ তথ্যের অভাব ছাঁটাইয়ের বেদনাকে আরও উসকে দেয়।

জোনাথন বুথ বলেন, যাঁরা বিমার ওপর নির্ভর করে চলেন, তাঁদের ছাঁটাইয়ের এ ধাক্কা সামাল দেওয়া বেশ কঠিন। আবার সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সব কর্মী রাখা সম্ভব হয় না। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট কভারেজের পরিবর্তে ‘সরকারপ্রদত্ত বেকারত্বের সুবিধা’ পেতে কর্মীদের সহায়তা করা উচিত।

ছাঁটাই করার বিষয়ে সৎ থাকতে হবে

মানবিকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছাঁটাই করা সহজ বিষয় নয়। প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা মানলে সব সময় কর্মীদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো সম্ভব হয় না।

ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক করপোরেট কোচিং কনসালট্যান্সি কালচার পার্টনারসের ওয়ার্কপ্লেস কালচার বিজ্ঞানী জেসিকা ক্রিগেল বলেন, ‘“মানবিক ছাঁটাই” একটি কৌশলগত শব্দ। কর্মী ছাঁটাই করা মানে ওই প্রতিষ্ঠানে কাজের সঙ্গে ওই কর্মীর আর কোনো সম্পর্ক নেই। কাজের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলে তাঁর প্রতি সক্রিয় সহানুভূতির দাবিও আর থাকে না। তবে যে কর্তা ব্যক্তি দাবি করেন যে তাঁরা ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাঁরা ভূমিকা সম্পর্কে নিজের সঙ্গে আর সৎ থাকতে পারেন না।’

যাঁরা বিমার ওপর নির্ভর করে চলেন, তাঁদের ছাঁটাইয়ের এ ধাক্কা সামাল দেওয়া বেশ কঠিন। আবার সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সব কর্মী রাখা সম্ভব হয় না। এ কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট কভারেজের পরিবর্তে ‘সরকারপ্রদত্ত বেকারত্বের সুবিধা’ পেতে কর্মীদের সহায়তা করা উচিত।জোনাথন বুথ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সহযোগী অধ্যাপক

একজন কর্মীকে ‘জ্ঞানী ও স্বচ্ছ’ বা ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হিসেবে দেখলে অন্যরা তাঁকে তেমন না-ও ভাবতে পারেন। তবে এর বিকল্প হিসেবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কর্মী ছাঁটাই কমাতে সিইও নিজের আর্থিক সুবিধা কাটছাঁট করছেন। যেমন জুম বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ হাজার ৩০০ কর্মী ছাঁটাইয়ে ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও এরিক ইউয়ানও চলতি বছর তাঁর বেতন ৯৮ শতাংশ কমানোর পাশাপাশি নির্বাহী হিসেবে বোনাস না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এটা একটি প্রশংসিত পদক্ষেপ।

তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট সম্প্রতি ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। চাকরিচ্যুতির এ খবর কর্মীদের এক আবেগঘন ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সুন্দর পিচাই। গত ডিসেম্বরে পিচাইয়ের নানা সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে গুগল তাঁর বেতন বিপুল অঙ্কে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া করোনা–পরবর্তী সময়ে বড় পরিসরে কর্মী ছাঁটাইয়ের ইস্যু নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা। এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক জাকারবার্গ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা ভাতা বাড়ানো হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি মেটার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জাকারবার্গ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বছরে মোট ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার নিরাপত্তা ভাতা পাবেন। আগে এর পরিমাণ ছিল ৪০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে নিরাপত্তা ভাতা বাড়ানো হয়েছে ১ কোটি ডলার।

একইভাবে ক্রিগেল বলেছেন, যখন ভিডিও কলে কর্মী ছাঁটাই করা হবে, তখন ওই কর্মী ভাবতে পারেন, জেনারেশন জি ও যারা ডিজিটাল মাধ্যমে সাবলীল, তারা এ ধরনের ভিডিও কলের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।

গত ২০ জানুয়ারি প্রায় ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেন গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই। কর্মী ছাঁটাইয়ের পুরো দায় নিজে নিয়ে কর্মীদের উদ্দেশে তিনি আবেগঘন চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিতে এত দিন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে যেসব কর্মী কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন পিচাই। তাঁদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে ক্রিগেল বলেন, ছাঁটাইয়ের প্রসঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেশ আবেগঘন কথা বলে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান কিছু না বলে সরাসরি ছাঁটাই করে দিচ্ছে। তবে কোনটি ভালো, তা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে। বিষয়টি প্রেমের সম্পর্ক শেষ করে ফেলার মতোই। তিনি বলেন, সম্পর্ক শেষের ক্ষেত্রে কেউ বলে আলোচনা করতে চান, কেউ যত দ্রুত সম্ভব যেভাবেই হোক কাজটি সেরে ফেলতে চান। একইভাবে সর্বজনীনভাবে সহানুভূতিশীল ছাঁটাইয়ের ধারণা একটি অসম্ভব বাস্তবতা হতে পারে।

কর্মক্ষেত্রে স্বচ্ছতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্মীদের আগে থেকেই জানাতে হবে যে কবে নাগাদ ছাঁটাইপ্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এতে ছাঁটাই হওয়ার আগেই কর্মীরা বিকল্প কাজের সন্ধান করতে পারেন।জেসিকা ক্রিগেল, ওয়ার্কপ্লেস কালচার বিজ্ঞানী

চাকরিচ্যুত কর্মী আর সম্পদ নন

জোনাথন বুথ বলেন, কর্মীদের অনুভব করতে হবে যে নিয়োগকর্তারা কথা বলার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করছেন। কেন ছাঁটাই করা হচ্ছে, তা কর্মীদের জানানো উচিত। আর এটা হতে হবে ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানবিক উপায়ে। যদি সম্ভব হয়, তাহলে সেই কর্মীদের মুখোমুখি হতে হবে। সঠিক সময়ে সব তথ্য প্রকাশ করাসহ কর্মীর সঙ্গে সব যোগাযোগই স্বচ্ছ হওয়া উচিত।

জেসিকা ক্রিগেল বলেন, কর্মক্ষেত্রে স্বচ্ছতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কর্মীদের আগে থেকেই জানাতে হবে যে কবে নাগাদ ছাঁটাইপ্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এতে ছাঁটাই হওয়ার আগেই কর্মীরা বিকল্প কাজের সন্ধান করতে পারেন।

হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ের একটি কলামের উদ্ধৃতি দিয়ে ক্রিগেল মানবিক ছাঁটাইয়ের পরিবর্তে ‘স্বচ্ছ বিচ্ছেদ’ শব্দটিকে সমর্থন করেছেন। এ শব্দের মাধ্যমে আসলে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে যতটা সম্ভব উন্মুক্ত আলোচনা করতে নিয়োগকর্তাদের আহ্বান জানানো হয়।

গত ২০ জানুয়ারি প্রায় ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেন গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই।

ছবি: এএফপি
গত ২০ জানুয়ারি প্রায় ১২ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেন গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই।

লন্ডন বিজনেস স্কুলের সাংগঠনিক আচরণ বিষয়ের অধ্যাপক ড্যান ক্যাবল বলেছেন, ‘(সহানুভূতি) বোঝায়, যাঁদের ছাঁটাই করা হচ্ছে, তাঁরা মানুষ, সম্পদ নন। তাঁদের সঙ্গে মানুষ হিসেবেই আচরণ করতে হবে, সম্পদ হিসেবে নয়। এতে ওই ব্যক্তিকে নতুন কাজ খুঁজে পেতে সহায়তা করার বিষয়টিও থাকবে।’

  • বিবিসি, রয়টার্স, ইন্ডিয়া টুডে ও এনডিটিভি থেকে ভাষান্তর আবু হেনা মোস্তফা কামাল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.