পাঠ্যবই কেন ছাপতে চায় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ, কতটা বাস্তবসম্মত

0
219
নতুন বই পাওয়ার আনন্দে মেতেছে ভেদভেদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা। রাঙামাটি, ৪ জানুয়ারি

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাঠ্যপুস্তক তৈরির উদ্দেশ্যে ‘পূর্ববঙ্গ স্কুল টেকস্টবুক কমিটি’ গঠিত হয়। এ কমিটির কাজ ছিল প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব বিষয়ের পাঠ্যপুস্তকের অনুমোদন প্রদান করা। পরে ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘টেকস্টবুক আইন’ পাস হয়। তার আলোকে ‘স্কুল টেকস্টবুক বোর্ড’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক প্রস্তুত ও বিতরণ ছিল এ প্রতিষ্ঠানের কাজ।

হাসি আর আনন্দে নতুন বছরের শুরু। বছর শুরুর দিনেই নতুন বই পেয়ে শিশুদের আনন্দ যেন আর ধরে না। হাতে বই পেয়েই দেয় ছুট। ছবিটি চট্টগ্রাম নগরের উত্তর কাট্টলী জয়তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তোলা

হাসি আর আনন্দে নতুন বছরের শুরু। বছর শুরুর দিনেই নতুন বই পেয়ে শিশুদের আনন্দ যেন আর ধরে না। হাতে বই পেয়েই দেয় ছুট। ছবিটি চট্টগ্রাম নগরের উত্তর কাট্টলী জয়তারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তোলা 

দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ১৯৮৩ সালে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে স্কুল টেকস্টবুক বোর্ড ও জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্রকে একীভূত করে বর্তমান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে নতুন আইন পাস হয়। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিতরণ, বিপণনসহ এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ করে আসছে এনসিটিবি।

এর মধ্যে ২০১০ সাল থেকে বছরের শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে নতুন বই তুলে দিচ্ছে সরকার। এ নিয়ে বছরের শুরুর দিন দেশজুড়ে চলে উৎসবের আমেজ। এনসিটিবির মাধ্যমে এ কাজ হয়। তবে এ বছর সময়মতো সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দিতে পারেনি এনসিটিবি। এমনকি শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রায় দুই মাস পরও অনেক বিদ্যালয়ে সব শিক্ষার্থীকে সব বই দিতে পারেনি। আবার এবার পাঠ্যবইয়ের মানও অন্যান্য বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রাথমিকের পাঠ্যবই এনসিটিবির মাধ্যমে না ছাপিয়ে নিজেদের অধীন ছাপার পরিকল্পনা করছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ

প্রাথমিকের পাঠ্যবই এনসিটিবির মাধ্যমে না ছাপিয়ে নিজেদের অধীন ছাপার পরিকল্পনা করছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ

এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যবই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৬ লাখের বেশি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বই। এবার বই ছাপার কাজে পুনর্দরপত্র দিতে হয়েছিল। আবার বই ছাপার অনুমোদনসংক্রান্ত কাজে মন্ত্রণালয় প্রায় এক মাস দেরি করেছিল। এ কারণে ছাপার কাজ শুরু করতেই দেরি হওয়ায় সময়মতো বই দেওয়া নিয়ে আগেই আশঙ্কা করেছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর মধ্যে ভালো মানের মণ্ডের সংকটসহ কিছু কারণে সময়মতো সব শিক্ষার্থীর হাতে মানসম্মত সব বই তুলে দেওয়া নিয়ে শঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়। এ জন্য শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও দায় আছে। কারণ, তাঁরা কাজগুলো ঠিক সময়ে, ঠিকভাবে করেননি। ফলে এ বছরের শুরুতে স্কুলে স্কুলে উৎসব করা হলেও শুরুতে সব শিক্ষার্থী সব বই হাতে পায়নি। এতে শিক্ষার্থীরাও সমস্যায় পড়েছে। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়েও বেকায়দায় পড়েছে এনসিটিবি। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরও তিনটি বইয়ের কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু এসব কারণে একদিকে শিক্ষার্থীরা যেমন সমস্যায় পড়ছে, অন্যদিকে আর্থিকভাবে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও দেখা দিয়েছিল।

এমন অবস্থায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি সভা করে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই এনসিটিবির পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়। এখন প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর প্রক্রিয়া করা হচ্ছে।

এনসিটিবির পরিবর্তে নিজেরাই পাঠ্যবই ছাপানোর পরিকল্পনার কারণ জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ কয়েকদিন আগে বলেন, দ্রুততার সঙ্গে পাঠ্যবই ছাপানো, সমন্বয়হীনতা কমানো, ছাপার কাজের অনুমোদনসংক্রান্ত ধাপ কমিয়ে আনা এবং এনসিটিবির ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ থাকায় এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। সরকার যদি নীতিগত সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে বসে ঠিক করা হবে পরবর্তীকালে কীভাবে ছাপার কাজটি করা হবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের পাঠ্যবই ছাপার প্রক্রিয়া যেহেতু এনসিটিবির মাধ্যমে শুরু হয়ে গেছে, তাই ২০২৫ সাল থেকে এনসিটিবির মাধ্যমে না ছাপিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে ছাপানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের এ পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আইন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ এটি করতে পারবে না। এটি করতে গেলে সমন্বয়হীনতা আরও বাড়বে।

আর প্রতিষ্ঠানের কী দোষ? এনসিটিবির কোনো ব্যক্তির দায় থাকলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বরং একই ছাতার নিচে কাজটি ঠিকমতো করা হলে সেটি সবার জন্য ভালো হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.