পাকিস্তানে কোণঠাসা ইমরান ভুট্টোর স্মৃতি মনে করাচ্ছেন

0
142
ইমরানের সমর্থকদের ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে পেশোয়ারের একটি স্থাপনা

জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো ইমরান খানকেও রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র। এ যেন ১৯৭৯ সালের পুনরাবৃত্তি।

কার্ল মার্ক্সের এই কথা অনেকেরই জানা, ‘ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে—প্রথমে ট্র্যাজেডি আকারে, দ্বিতীয়বার প্রহসনরূপে।’ এই উক্তির পক্ষে বিস্তর নজির আছে। আপাতত আমরা ইমরান খানের পরিণতির দিকে চোখ রাখতে পারি।

একটা অনুমান হচ্ছে, তাঁর পরিণতি জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো হতে যাচ্ছে। ‘ফাঁসি’র অংশটুকু বাদ দিয়ে হলেও ইমরান খানকে ইমরান ভুট্টোতে পরিণত করার আয়োজন চলছে।

মার্ক্সের উক্তির আলোকে পাকিস্তানের রাজনীতির এই নব অধ্যায়কে কীভাবে শনাক্ত করা ঠিক হবে—ট্র্যাজেডি, না প্রহসন—সেটা একটা প্রশ্ন। কেউ কেউ বলছেন, এসব প্রশ্নের উত্তর আছে ইমরান এখন যে পাড়ায় বাস করছেন, সে-ই ‘জামান পার্কের’ ইতিহাসের ভেতরই।

যে হত্যা মামলাটি বিশেষভাবে নজর কাড়ছে

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একের পর এক হামলা ও মামলার শিকার ইমরান ও তাঁর সহযোগীরা। ইমরানের বিরুদ্ধে কেবল ইসলামাবাদেই ২৮টি মোকদ্দমা রুজু হয়েছে। তার মধ্যে ২০টি মামলার বিচার চলছে।

সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১২১। এর মধ্যে সর্বশেষ মামলাটি পাকিস্তানকে তড়িৎস্পৃষ্ট করেছে। আপাতদৃষ্টে এটি অন্যান্য মামলার মতোই নিরীহ। আবদুল রাজ্জাক নামে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী খুন হয়েছেন। সে হত্যা মামলায় ইমরানকে প্ররোচনার আসামি করা হয়েছে। মামলাটি দায়ের হয়েছে আবদুল রাজ্জাকের ছেলে সিরাজ আহমেদের ইচ্ছায়। সেখানে খুনের পেছনে ইমরানের ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

আবদুল রাজ্জাক খুন হয়েছেন বেলুচিস্তানের কোয়েটায়, চলন্ত গাড়িতে গুলি করে। তাঁর শরীরে ১৬টি গুলি লেগেছিল। হত্যাকারীরা ধরা পড়েনি। তদন্ত শুরুর আগেই সরকারের অনেকে বলতে শুরু করেন, খুনটির পেছনে ইমরানের হাত আছে। প্রথম অভিযোগ তোলেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বিশেষ সহকারী আত্তা তারার। তিনি মুসলিম লিগের বেশ মারকুটে নেতা।

জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইমরান খান
জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইমরান খান

আত্তা তারারের অভিযোগের ভিত্তি হলো, আবদুল রাজ্জাক বেলুচিস্তান হাইকোর্টে ইমরান খানের বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদী। মামলাটিতে ইমরানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ ছিল।

৬ জুন ছিল মামলার শুনানির তারিখ। সেদিনই রাজ্জাক খুন হন। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়, মামলার দিনটিতে নয়—রাজ্জাক খুনের দিন পাকিস্তানজুড়ে এই ঘটনা আলোড়ন তোলে। সবাই ভাবছেন, কেন ৩০ মে এমন একটি অভিযোগ দায়ের হলো এবং সাত দিন পর শুনানির তারিখেই বাদী খুন হলেন? অধ্যায় দুটোতে কি কোনো যোগসূত্র আছে?

পাকিস্তানের ইতিহাস সম্পর্কে অভিজ্ঞরা জানেন, ২০২৩ সালের ৩০ মে এবং ৬ জুনের মধ্যে যোগসূত্র থাকুক বা না থাকুক—জুলফিকার আলী ভুট্টোর আমলের একটা মামলার সঙ্গে এই অধ্যায়ের কিছু বিপজ্জনক মিল আছে।

জামিনের আড়ালে দর–কষাকষি?

জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা হারিয়েছিলেন ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই। সময়টা ছিল আগে থেকে উত্তাল। বিরোধী দলগুলো ভুট্টোর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন করছিল। সে সুযোগে সেনাবাহিনী ক্ষমতা কেড়ে নেয়।

ক্ষমতা হারানোর প্রায় দুমাস পর এক হত্যা মামলায় ভুট্টোকে স্থায়ীভাবে আটক করা হয়। মাঝখানের দুই মাসেও তিনি একাধিক দফা আটক হন, টুকটাক যেভাবে ইমরানও হচ্ছেন! আবদুল রাজ্জাক হত্যা মামলায় ৮ জুন ১৪ দিনের জামিন পেয়েছেন ইমরান। এ–জাতীয় জামিনগুলো যে দর–কষাকষির অংশ, সেটা সবাই বুঝতে পারছেন। জামিনের মেয়াদ শেষে কী হবে, সেটা নির্ভর করছে ‘ডিপ স্টেটের’ সঙ্গে ইমরানের বোঝাপড়ার ওপর।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় ভুট্টোর বিরুদ্ধে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে গণকারচুপির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ ছিল। সেনাবাহিনী সেটা কাজে লাগায়। তবে আটকের পর ভুট্টোর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। জেনারেল জিয়াউল হক তখন ভুট্টোকে থামাতে একটা হত্যা মামলা খুঁজে বের করেন।

১৯৭৪ সালে লাহোরে আহমেদ রাজা কাসুরি নামের একজন রাজনীতিবিদকে হত্যার জন্য তাঁর গাড়িতে হামলা করা হয়েছিল। হামলায় রাজা কাসুরি বেঁচে গেলেও তাঁর বাবা আহমেদ কাসুরি নিহত হন। রাজা কাসুরি পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) করলেও ভুট্টোর অনুগত ছিলেন না। গুঞ্জন ছিল, হামলায় ভুট্টোর ইন্ধন আছে। রাজা কাসুরি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে শপথ করে বলেছিলেন, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবেন। তবে ভুট্টো ক্ষমতায় থাকাকালে সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি।

১৯৭৮ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতায় এলে এ ঘটনার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ভুট্টোর ফাঁসি হয় এই মামলাতেই। ফাঁসির আগের দিনও ভুট্টো বিশ্বাস করতে পারেননি, তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। কিন্তু সেটাই হয়েছিল। ১৯৭৩ সাল থেকে ভুট্টো দেশটির শক্তিশালী সামরিক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সংঘাতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।

সামরিক আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর ন্যায্য ক্ষোভ ছিল। প্রতিষ্ঠানটির অহংয়ে তিনি বারবার ঘা দিচ্ছিলেন। নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর অতিরিক্ত আস্থাশীল হয়ে বিরোধী দলগুলোকে অত্যাচার-নির্যাতন করে তিনি এক জায়গায় জড়ো হওয়ার সুযোগ করে দেন। বলা যায়, ইমরানও এই দুটি ভুল ভালোভাবে করেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং এর সাম্প্রতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দলের অবস্থানে আপস করার মতো কোনো ফাঁকফোকর নেই। উপরন্তু সেনাস্থাপনাগুলোতে পিটিআই কর্মীদের ভাঙচুর সামরিক আমলাতন্ত্রের মর্যাদায় আঘাত দিয়েছে। ঠিক এমন এক পটভূমিতে পাকিস্তানে এ মাসে আবদুল রাজ্জাক হত্যা মামলা চালু হলো। ইমরান হয়তো শিগগির গ্রেপ্তারও হবেন। ইতিমধ্যে তাঁর দল ভাঙার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।

ভুট্টোর মতো ইমরানও ক্ষমতাচ্যুতির জন্য সেনাপ্রধানের পাশাপাশি বারবার আমেরিকাকে দায়ী করে ছিলেন। যদিও এর অনুকূলে জোরালো কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

ইমরানকে রাজনীতি ছাড়তে বলা হচ্ছে

ভুট্টো আর ইমরানের অবস্থার তুলনা অবশ্য একটি জায়গায় বেশ বেমানান। ভুট্টোর দুর্দিনে খুব কম সহযোগীই তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইমরানের দুর্দিন শুরু হওয়া মাত্র অবিশ্বাস্য গতিতে সহযোগীরা তাঁকে ছেড়ে যেতে শুরু করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম কেবল শাহ মাহমুদ কুরেশি। এখনো তিনি দলে আছেন।

পিটিআইয়ের দ্বিতীয় প্রধান নেতা মনে করা হতো শাহ মাহমুদ কুরেশি আর আসাদ উমরকে। প্রথমজন ছিলেন ইমরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরের জন অর্থমন্ত্রী। দ্বিতীয়জন এরই মধ্যে দল ছেড়েছেন। কুরেশিকে নিয়েও গুঞ্জন উঠেছে। কারও কারও ধারণা, সামরিক আমলাতন্ত্র তাঁকে দিয়ে ইমরান খানকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে রাজি করানোর চেষ্টায় আছে।

কুরেশি যে অবস্থানে আছেন, তাতে তাঁর কথা ইমরানকে শুনতে হবে। তবে ইমরান রাজনীতি ছাড়তে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। নানা মাধ্যমে তিনি এখন আমেরিকার সহানুভূতিও চাইছেন। ভুট্টোও শেষ দিনগুলোতে ইরানের শাহের মাধ্যমে হেনরি কিসিঞ্জারের করুণা চেয়েছিলেন।

প্রায় প্রতিদিন ইমরানের দলের কেউ না কেউ পদত্যাগ করছেন। সামরিক আমলাতন্ত্র চাপ দিয়ে এসব পদত্যাগ ঘটাচ্ছে। পদত্যাগকারীদের মামলা ও দীর্ঘ জেলজীবনের ভয় দেখানো হচ্ছে। সামরিক বাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, তারা বিভিন্ন সেনাস্থাপনায় হামলাকারী পিটিআই সংগঠকদের সেনা আইনে বিচার করবে। এ ঘোষণা পিটিআইয়ের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

ইমরান খানকে কি তাঁর অহংকারের পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে?

পদত্যাগীরা ইতিমধ্যে ‘ইস্তেহখামে পাকিস্তান’ (স্থিতিশীল পাকিস্তান) নামে ইমরানের একসময়কার সহযোগী জাহাঙ্গীর তারিনের নেতৃত্বে নতুন একটি দলও গঠন করে ফেলেছেন। ঠিক একইভাবে ১৯৭৮ সালে ভুট্টোকে ছেড়েছিলেন গোলাম মোস্তফা জাতোই আর মাওলানা কাওসার নিয়াজি। বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ হয়েও ভুট্টো রাষ্ট্রের ভেতরকার রাষ্ট্রের এসব কৌশল সামাল দিতে পারেননি। প্রস্তুতও ছিলেন না।

ক্রিকেটে ইমরান ভালো অধিনায়ক ছিলেন। হয়তো বুঝতে পারছেন সামনে প্রতিপক্ষ কী করবে। ইতিমধ্যে তিনি বলে রেখেছেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে দল চালাবেন কুরেশি। এ রকম এক অবস্থায় ভুট্টো নুসরাতকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নুসরাত নির্যাতনের মুখে পড়েন। কুরেশি অত ঝুঁকি নেবেন বলে মনে হয় না। তিনি নিজে রাজনীতিতে এসেছেন জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে সামরিক ছত্রচ্ছায়ায়। তাঁর বাবা সাজ্জাদ হোসেন কুরেশি ভুট্টোর দল থেকে বেরিয়ে জিয়াউল হককে সমর্থনের বিনিময়ে পাঞ্জাবের গভর্নর হন। মুসলিম লিগ আর পিপিপি, পাকিস্তানের প্রধান এই দুটি দলেই কিছুদিন করে ছিলেন শাহ কুরেশি। দেশটির কুলীন রাজনীতির ব্যাকরণ তাঁর জানা। আদর্শের বদলে ক্ষমতাকেই সেখানে গুরুত্ব দেওয়ার রেওয়াজ। যত দূর বোঝা যাচ্ছে, দল রক্ষার বিনিময়ে কুরেশি ইমরানকে নমনীয় হতে বলছেন।

কুরেশিসহ সবাই দেখছেন, সেনা–আমলাতন্ত্র ইমরানকে ‘রাজনীতি থেকে মাইনাসের’ প্রশ্নে আপসহীন। এ রকম মাইনাস ফর্মুলা যে লক্ষ্য অর্জনে সফল হয় না, উপমহাদেশের ইতিহাসে সেটা বহুবার দেখা গেছে। ভুট্টোকে মাইনাস করা গেলেও বেনজিরেরর উত্থান থামানো যায়নি। পিপিপিও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ইমরানের জনপ্রিয়তার উৎস যদি হয় জনগণ, তাহলে হত্যা মামলা দিয়ে তাঁকে উৎপাটন কঠিন। তবে ইমরানকে আপাতত থামতে হবে। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিলের মতো কোনো খারাপ সমাপ্তির আগেই একটা আপস হলে ইমরান ও সামরিক আমলাতন্ত্র উভয়ের জন্যই তা ভালো। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ভার বইতে বইতে দেশ হিসেবে পাকিস্তান এখন ক্লান্ত।

‘সুন্দর দাস পার্ক’ যেভাবে ‘জামান পার্ক’

পাকিস্তানের জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার যে তাদের ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী’ ‘খান সাহেব’কে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। কেবল প্রশাসন আর রাজনীতিতে নয়, কর্তৃত্ববাদী এ মানসিকতার গোড়া রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ-ইতিহাসের আরও গভীরে।

ইমরানের সমকালীন পরিণতির মধ্যে ভুট্টোর ছবি যেভাবে ভেসে উঠছে, চাইলে ইমরানের বসতবাড়ি জামান পার্কের ইতিহাসের ভেতরও আমরা দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ববাদী কুলীন সংস্কৃতির প্রায় একই চেহারা দেখতে পাব।

পাকিস্তানের টিভি ও পত্রপত্রিকায় এখন অহরহ ‘জামান পার্ক’ শব্দবন্ধটি শোনা যায়। লাহোরের এই জায়গায় গত কয়েক মাস ধরে ইমরান আছেন। ব্রিটিশ আমলে মানুষ এলাকাটিকে চিনত ‘পাঞ্জাব লাইট হাউস প্যারেড গ্রাউন্ড’ নামে। ব্রিটিশ বাহিনীর গ্যারিসনও ছিল এখানে। তারও আগে এর প্রকৃত নাম ছিল সুন্দর দাস সড়ক বা ‘সুন্দর দাস পার্ক’। এলাকাটি ছিল হিন্দুবসতি। রায় বাহাদুর সুন্দর দাস সুরি ছিলেন এলাকাপ্রধান; ছিলেন অখণ্ড পাঞ্জাবের প্রধান স্কুল পরিদর্শক।

ইমরান খানের গ্রেপ্তার অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিল

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এলাকাটির বাসিন্দা বদল হয়। ব্রিটিশ বাহিনীও তত দিনে এলাকা ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। পাড়ায় বসতি করে জলন্ধরের কুলীন পাঠানদের দল। তাদের অভিভাবক ছিলেন খান বাহাদুর জামান খান। তিনি ছিলেন অখণ্ড পাঞ্জাবের পোস্টমাস্টার জেনারেল।

জামান খান ও তাঁর আত্মীয়স্বজন সুন্দর দাস সুরিদের ইতিহাস চাপা দিয়ে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেন এখানে। এলাকার নাম হয় জামান পার্ক। গত আট দশকে জলন্ধরী পাঠানদের সংখ্যা এখানে অনেক বেড়েছে। এলাকাটি ক্রিকেটার ও জেনারেলদেরও প্রিয়। ইমরান মাতৃসূত্রে খান বাহাদুর জামান খানের উত্তরসূরি। তাঁর ক্রিকেটপ্রীতি মায়ের বংশলতিকার সূত্রে। খানের মাতৃ–খানদানের পুরুষেরা অনেকে ছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলোয়াড়।

সুন্দর দাস আর জামান খান—দুটোই দক্ষিণ এশিয়ার সেই কুলীন ঐতিহ্যের প্রতীক, যাঁরা ‘অপর’–এর ঐতিহ্য ধুয়েমুছে ইতিহাসে নিজের নাম খোদাই করতে চেয়েছেন। ভুট্টোও ছিলেন এ রকম কুলীনদেরই এক রাজনৈতিক প্রতিনিধি। ভুট্টোকে কাছে টেনে নেন আরেক কুলীন ইসকান্দার মির্জা, আইয়ুব খান। ভুট্টোকে থামিয়েও দিয়েছে এই একই গোষ্ঠী।

তবে সিন্ধুর ভূস্বামীদের দল পিপিপি এখনো টিকে আছে। ভুট্টোবিরোধী অভ্যুত্থানের প্রধান দুই চরিত্র জেনারেল জিয়া ও জেনারেল চিশতি এবং ভুট্টোর ফাঁসির রায় চূড়ান্তকারী প্রধান বিচারপতি আনোয়ার-উল-হক ছিলেন ‘জলন্ধরী’ কুলীন। দেশটির নিচুতলার মানুষেরা এঁদের কাজকারবার দেখেছে কেবল গ্যালারি থেকে দর্শকের মতো। ইমরানের সঙ্গে সামরিক আমলাতন্ত্রের চলতি সংঘাতেও পাকিস্তানের অকুলীনদের খুব বেশি অংশীদারত্ব ও আগ্রহ নেই।

শরিফ বংশকে কোণঠাসা করতে যে ‘ডিপ স্টেট’ ইমরান খানকে ক্রিকেট ও সমাজকর্ম থেকে রাজনীতিতে টেনে এনেছিল, তারাই এখন তাঁকে অবসরে পাঠাতে চাইছে। কখনো রাজনৈতিক আন্দোলন উসকে দিয়ে, কখনো ভোটের মাধ্যমে এ যেন বারবার একই বাগানের নামবদল—কখনো সুন্দর দাস পার্ক, কখনো জামান পার্ক। বাগান থাকছে, বাগানের মালিকানাও একই শ্রেণির কাছে থাকছে। সময়-সময় কেবল তার নামবদল হচ্ছে।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.