পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ২৩ আগস্ট ঢাকায় আসছেন। গত তিন দশকের মধ্যে এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশে আসছেন। তিনি তাঁর সফরের দ্বিতীয় দিন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ইসহাক দার তাঁর সফরের দ্বিতীয় দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দুই দেশের দেড় দশকের শীতল সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে গত এপ্রিলে ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ। এরই ধারাবাহিকতায় ইসহাক দার তাঁর সফরে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্তরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
ঢাকা সফরের সময় ইসহাক দার বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ২৩ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দ্বিপক্ষীয় সফরে ঢাকায় আসছেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি হতে পারে ২৪ আগস্ট।
আসন্ন ঢাকা-ইসলামাবাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের অগ্রাধিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এখনো আলোচ্যসূচি ঠিক হয়নি। আশা করছি, আগস্টের শুরুতে তা চূড়ান্ত করা হবে।’
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে দুই দেশের নানা পর্যায়ের আলোচনা সক্রিয় করার ওপর জোর দিয়ে আসছে পাকিস্তান। এরই অংশ হিসেবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক করতে গত এপ্রিলে ঢাকায় এসেছিলেন।
ইসহাক দারের ঢাকা সফরের পর পাকিস্তান দুই দেশের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠক ইসলামাবাদে আয়োজন করতে চাইছে। দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ (অষ্টম) জেইসি বৈঠক ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
গত ২৭-২৮ এপ্রিল ইসহাক দারের ঢাকা সফরের কথা ছিল; কিন্তু ‘অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির কারণে’ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২৪ এপ্রিল তাঁর সফর স্থগিতের কথা জানায়। তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, দুই পক্ষের পরামর্শের ভিত্তিতে সফরের নতুন তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। এ ঘটনার জেরে সংঘাতে জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান। উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে তখন ইসহাক দারের ঢাকা সফর স্থগিত হয়।
অমীমাংসিত ইস্যুতে জোর থাকবে
প্রায় ১৫ বছরের বিরতি শেষে ঢাকায় গত ১৭ এপ্রিল বৈঠকে বসেছিলেন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবেরা। বৈঠকে দুই দেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আলোচনার অন্য প্রক্রিয়াগুলো নিয়মিত রাখার ওপর জোর দেয়। ফলে এ আলোচনাকে দেখা হয় দেড় দশকের স্থবির সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের প্রথম ধাপ হিসেবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ওই আলোচনায় বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া ও অভিন্ন স্বার্থে জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বার্তা দেওয়া হয়, সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের সম্পর্ক যেখানে এসেছে, তা এগিয়ে নিতে হলে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত সুরাহা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তিন ঐতিহাসিক ইস্যুতে জোর দেয়। সেগুলো হলো একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন ও অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান। পাকিস্তান এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে।
তবে পরে বৈঠক নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিজ্ঞপ্তি দেয়, তাতে এই ইস্যুগুলো ঊহ্য রাখা হয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সুসম্পর্ক রাখতে আগ্রহী; কিন্তু এই সম্পর্ক নিশ্চয়ই অমীমাংসিত তিন ঐতিহাসিক ইস্যুকে বাদ দিয়ে হবে না। গত ডিসেম্বরে মিসরের কায়রোতে ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের আলোচনা হয়। এ আলোচনায় শাহবাজ শরিফকে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘বিষয়গুলো বারবার আসছে। আসুন, আমরা সামনে এগিয়ে যেতে এই বিষয়গুলোর ফয়সালা করি।’ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিষয়গুলো চিরতরে সুরাহা করে ফেলা ভালো হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, প্রধান উপদেষ্টা যখন অমীমাংসিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলো ফয়সালার কথা বলছেন, তখন এগুলোকে বাদ দিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে জেইসিসহ বিভিন্ন খাতের বৈঠকে অংশ নিতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অনীহা নেই। কিন্তু কিছুটা ধীরে এগোনোই সমীচীন।
২০১০ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল ইসলামাবাদে। সেই বৈঠকের পরও একাত্তরে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়াসহ তিন অমীমাংসিত ইস্যুর কথা পাকিস্তানের বিজ্ঞপ্তিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। অবশ্য বাংলাদেশের বিজ্ঞপ্তিতে প্রসঙ্গগুলোর উল্লেখ ছিল। ২০১০ সালেও পাকিস্তান অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছিল।
ব্যবসা-বাণিজ্যে দৃষ্টি
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহী। এমনকি ইসহাক দারের আসন্ন বাংলাদেশ সফরে তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের শীর্ষ কিছু ব্যবসায়ীর আসার কথা রয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গত ১৪ জানুয়ারি জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল গঠনে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা। এরপর গত ২৮ এপ্রিল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম’ অনুষ্ঠিত হয়। দুই দেশের পোশাক খাতে ব্যবসা বাড়াতে এই ফোরামে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সঙ্গে পাকিস্তান তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (পিআরজিএমইএ) এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়।
সরকারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্য আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯১৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫৬ মিলিয়ন ডলারে। কিন্তু আর্থিক মন্দার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ আবার কমে যায়।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানি করে। পাশাপাশি খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিলে তা সংগ্রহের অন্যতম উৎস হয় পাকিস্তান। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট, চা, কাঁচা ও কিছুটা প্রক্রিয়াজাত চামড়া এবং হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আমদানি করে পাকিস্তান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের সাবেক কয়েকজন কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সম্পর্ক গভীর করার বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছে। দেশটির গত কয়েক মাসের তৎপরতায় তা স্পষ্ট। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। ভিসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কাটতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের একটি কম খরচের (লো-কস্ট) বেসরকারি উড়োজাহাজ চলাচল সংস্থা ফ্লাই জিন্নাহকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরপর এয়ারসিয়াল নামের পাকিস্তানের আরেকটি বেসরকারি উড়োজাহাজ চলাচল সংস্থা বাংলাদেশে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদন পেয়েছে।
একাধিক কূটনীতিক পর্যবেক্ষক বলেন, গত ১৫ বছর ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কে যে স্থবিরতা ছিল, তার অবসান হওয়া উচিত। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, লোকজনের অবাধ চলাচলসহ নানা ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে। তবে জটিল হলেও ঐতিহাসিক তিন অমীমাংসিত সমস্যার সুরাহার গুরুত্ব যেন বাংলাদেশ ভুলে না যায়।
রাহীদ এজাজ
ঢাকা