যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারিভাবে গম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গম রপ্তানিকারক সমিতি বা ইউএস হুইট সমিতির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য অধিদপ্তর এই চুক্তি করেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সমঝোতা চুক্তির আওতায় আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে ৭ লাখ টন উচ্চমানের গম আমদানি করা হবে। আজ রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এই চুক্তি সই হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর ও ইউএস হুইট সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ কে সওয়ার।
চুক্তি শেষে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এ সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আস্থা এবং পারস্পরিক বাণিজ্য সহযোগিতার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি হবে। উভয় দেশের জনগণ এতে উপকৃত হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি থেকে আমদানি বাড়াতে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে গম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এত দিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আসত সাহায্য হিসেবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি দাম দিয়ে হলেও গম আমদানি করা হবে। তারই অংশ হিসেবে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে সমঝোতা চুক্তি করা হয়।
* প্রতিযোগিতামূলক দামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা হবে উচ্চমানের গম।
* সরকারিভাবে প্রথমবারের মতো দেশটি থেকে গম কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনতে দেশটি থেকে কী কী পণ্য আমদানি করা যায়, তা জানতে গত এক সপ্তাহজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ধারাবাহিক এসব বৈঠকের শেষটি অনুষ্ঠিত হবে ২২ জুলাই মঙ্গলবার। বৈঠকটি হবে আমেরিকান অ্যাপারেলস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও জুতা আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে এই সংস্থা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন, এক্সিলারেট এনার্জি এবং ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটস, ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) ও ইউএস কটন অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।
বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে দুই দফা আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত কোনো ফয়সালা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো চিঠির ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ আগস্ট নতুন হার কার্যকর হলে বিদ্যমান ১৫ শতাংশের সঙ্গে নতুন হার যোগ হয়ে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্কহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে আরেক দফা আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রে যাবে। এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা গত শনিবার বলেন, তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনো পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার তারিখের জন্য সময় চেয়ে আবারও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে অনুরোধ করা হবে।
বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনতে…
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ব্যবধান বরাবরই বাংলাদেশের পক্ষে, যা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অসন্তুষ্টি রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এক বছর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৭৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। তার বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ দেশটি থেকে আমদানি করেছে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। অথচ এক বছর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি করেছিল ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একক পণ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় স্ক্র্যাপ লোহা বা লোহার টুকরা। আর দেশটিতে একক পণ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা হয় তৈরি পোশাক।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, গমের পাশাপাশি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, ভোজ্যতেল, তুলা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ইত্যাদি আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনবে বাংলাদেশ, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ আগে থেকেই ১৯০টি পণ্যের শুল্কহার শূন্য রেখেছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট করার সময় আরও ১০০ পণ্যকে এই তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। যদিও এ সুবিধা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্য দেশও পাবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কোনো দেশের নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো যায় না। শুল্ক কমাতে হয় পণ্যের ওপর। কেউ যদি শুধু একটি দেশের কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক কমায়, তাহলে অন্য কোনো দেশ ডব্লিউটিওর কাছে অভিযোগ করতে পারে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ বিষয়ে বলেন, ‘বাণিজ্য কৌশল যেন এক দেশমুখী না হয়ে যায়। কারণ, রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্য অংশীদারদেরও অবদান কম নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে যে বাণিজ্য চাপ দেওয়া হচ্ছে, ডব্লিউটিওর ভূমিকা সেখানে হতাশাজনক।’
ডলার–সংকটের এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চ দামে গম আমদানি, প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে অন্য পণ্য আমদানির উদ্যোগ এবং আপাতত চাহিদা না থাকলেও উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ আমদানির যে কথা শোনা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন গোলাম মোয়াজ্জেম।