রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খায়রুন্নাহার লিপির বড় সন্তান ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোহাম্মদপুর থানার মধ্যে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। ফোনে তিনি খবরটি সন্তানকে জানালে সেও খুশিতে নেচে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে খায়রুন্নাহার লিপি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সন্তানের ছবিসহ স্ট্যাটাসে এই খুশির খবর শেয়ার করেন। তবে বিকেল নাগাদ ওই আনন্দে ভাটা পড়ে; যখন তিনি জানতে পারেন প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল স্থগিত করা হয়েছে। কীভাবে সন্তানকে খবরটি জানাবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। খায়রুন্নাহার লিপি বলেন, ছেলেকে এখনও বলিনি, বললে সে আঘাত পাবে। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল স্থগিত করায় লিপির মতো সারাদেশের ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থীর অভিভাবকও একই রকম বিপাকে পড়েন। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মন খারাপ হয়। এবার সারাদেশের মোট ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ফল প্রকাশ করেন প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত। তখন জানানো হয়, এবার সারাদেশে বৃত্তি পেয়েছে ৮২ হাজার ৩৮৩ জন। কিন্তু ফল প্রকাশের পরপরই এ নিয়ে সারাদেশ থেকে বিভিন্ন বিস্ময়সূচক খবর আসতে থাকে অধিদপ্তরে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ও শিক্ষকরা এ ফল নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। কারণ মেধাবীদের পরিবর্তে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে তুলনামূলক কম মেধার শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পেয়েছে বলে খবর আসতে থাকে। কুড়িগ্রামের একটি বিদ্যালয় থেকে খবর আসে, পরীক্ষা না দিয়েই এক শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর পর চার ঘণ্টার মধ্যে বিকেল পৌনে ৫টায় ফল স্থগিত করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ই-মেইল পাঠিয়ে সব ডিপিইওকে (জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা) নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, ঘোষিত ফল স্থগিত করা হয়েছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সব প্রধান শিক্ষককে তা জানাতে বলা হয়। আরও জানানো হয়, সংশোধিত ফল আজ বুধবার দিনের মধ্যে যাবে। তবে কী কারণে ফল স্থগিত করা হয়েছে, তা জানানো হয়নি। বেশ কয়েকজন ডিপিইও ই-মেইল পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কারিগরি ত্রুটির কারণে ফল স্থগিত করা হয়েছে। আজ বুধবারের মধ্যে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হবে। এ বিষয়ে ফল প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সিস্টেম অ্যানালিস্ট অনুজ কুমার রায় বলেন, ফল তৈরির সময় কোডিংয়ে কিছু ভুল হয়েছে। তা সংশোধনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন। একই বিষয়ে জানতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহম্মেদ ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতকে ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি। যে কারণে ফল স্থগিত : জানা গেছে, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মুড়াকড়ি গ্রামে ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ফরদাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৭ জন বৃত্তি পেয়েছে। বৃত্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ওই স্কুলের ১ থেকে ১০ রোল নম্বরধারী কেউ নেই। ১০-এর পরে রোল নম্বরধারীরা বৃত্তি পেয়েছে। অন্যদিকে, পরীক্ষায় অনুপস্থিত থেকেও সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছে এক শিক্ষার্থী। তার নাম সজীব আলী। সে উপজেলার চর গোরকমণ্ডল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চর গোরকমণ্ডল গ্রামের হুজুর আলী ও ছকিনা বেগম দম্পতির সন্তান। তার বৃত্তি পরীক্ষার রোল নম্বর ২৪। উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে জানা যায়, সজীব আলী ফরম পূরণ করলেও ৩০ ডিসেম্বর ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। গতকাল বৃত্তির ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, এই উপজেলায় ৪৪ শিক্ষার্থী ট্যালেন্টপুলে এবং ৩৭ শিক্ষার্থী সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছে। এদের মধ্যে ফলের শিটে সজীবের রোল রয়েছে। এ বিষয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামান বলেন, বিষয়টি শুনেছি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছেন, ওই ছাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। ফলের শিটে তার রোল কীভাবে এসেছে, তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। জানা গেছে, প্রাথমিক বৃত্তির অদ্ভূতুড়ে এই ফল প্রকাশের ঘটনা খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কমিটির নেতৃত্বে আহ্বায়ক করা হয়েছে অধিদপ্তরের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এসএম আনছারুজ্জামানকে। কমিটিকে কাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কেন ফলে বিভ্রাট ঘটল জানতে চাইলে ডিপিইর পরিচালক (প্রশিক্ষণ বিভাগ) ড. উত্তম কুমার দাস বলেন, দুটি উপজেলার ওয়েবসাইটে ফল কোডিং আকারে প্রবেশের সময় একই কোডে প্রবেশ করায় এমন বিপর্যয় ঘটেছে। এ দুই উপজেলার কোড যখন কম্পিউটারের মূল প্রোগ্রামের প্রবেশ করেছে তখনই এমন ভুল হয়েছে। এ ভুলগুলো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটে। কিন্তু সেই যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি তাঁরা বুঝতে পারেননি। ফলে ভুল রয়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সারাদেশে নয়। শুধু কয়েকটি জেলার ফল পরিবর্তিত হতে পারে। যা ছিল প্রকাশিত ফলে : এর আগে দুপুরে প্রকাশিত ফলে বলা হয়, পঞ্চম শ্রেণিতে ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে ট্যালেন্টপুলে ৩৩ হাজার ও সাধারণ কোটায় ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন। জানানো হয়, বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বৃত্তি পাবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ফল দেওয়ার পর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তা সরিয়ে নেওয়া হয়।