আমাদের সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষায় আমাদের একটি আইনও রয়েছে। এই আইনটি হলো, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫। এই আইনটি পরে সংশোধন করা হয়, যা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০ নামে পরিচিত।
এই আইন অনুসারে, ‘পরিবেশ’ অর্থ পানি, বায়ু, মাটি, ও ভৌত সম্পদ ও এদের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্কসহ এদের সঙ্গে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্ক। ‘দূষণ’ অর্থ বায়ু, পানি বা মাটির তাপ, স্বাদ, গন্ধ, ঘনত্ব বা এদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনসহ বায়ু, পানি বা মাটির দূষিতকরণ বা এদের ভৌতিক, রাসায়নিক বা জৈবিক গুণাবলিসমূহের পরিবর্তন, অথবা বায়ু, পানি, মাটি বা পরিবেশের অন্য কোনো উপাদানের মধ্যে তরল, গ্যাসীয়, কঠিন, তেজস্ক্রিয় বা অন্য কোনো পদার্থের নির্গমনের মাধ্যমে বায়ু, পানি, মাটি, গবাদিপশু, বন্য প্রাণী, পাখি, মাছ, গাছপালা বা অন্য সব ধরনের জীবনসহ জনস্বাস্থ্যের প্রতি ও গৃহকর্ম, বাণিজ্য, শিল্প, কৃষি, বিনোদন বা অন্যান্য ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক, অহিতকর বা ধ্বংসাত্মক কার্য।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে অপরাধ ও শাস্তি
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে কিছু কাজের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এগুলো অমান্য করলে বা আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। এগুলো হলো:
স্বাস্থ্য হানিকর বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণকারী যানবাহন চালানো যাবে না বা এরূপ ধোঁয়া বা গ্যাস নিঃসরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনোভাবে এসব যানবাহন চালু করা যাবে না৷ কেউ এ ধরনের কাজ করলে প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড; দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা এবং পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ১ (এক) বছর কারাদণ্ড বা ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
পলিথিন শপিং ব্যাগ বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি অন্য কোনো সামগ্রী বা অন্য যেকোনো সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হলে গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সমগ্র দেশে বা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সরকার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে পারবে। প্রজ্ঞাপনে নির্ধারিত শর্তাধীনে ওই সব কার্যক্রম পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ জারি করতে পারবে এবং এ নির্দেশ পালনে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি বাধ্য থাকবেন।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ করলে প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত সামগ্রী বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে অনধিক ১ (এক) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কাটা যাবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণ করে কোনো পাহাড় বা টিলা কাটা যাবে। আইন বহির্ভূতভাবে পাহাড় ও টিলা কাটলে প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
পরিবেশের ক্ষতি রোধ করতে সরকার অন্যান্য আইনের বিধান সাপেক্ষে বিধি দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ধারণ, মজুতকরণ, বোঝাইকরণ, সরবরাহ, পরিবহন, আমদানি, রপ্তানি, পরিত্যাগকরণ ডাম্পিং, ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কেউ আইন ভঙ্গ করলে প্রথমবার অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
কোনো জাহাজ কাটা বা ভাঙার ফলে কোনো প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি যাতে সৃষ্টি না হয়, তা প্রত্যেক জাহাজের মালিক, আমদানিকারক এবং জাহাজ কাটা বা ভাঙার কাজে ইয়ার্ড ব্যবহারকারী নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে। কেউ আইন ভঙ্গ করলে প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে জলাধার সম্পর্কিত বাধানিষেধ শিথিল করা যাবে। এ বিষয়ে কেউ আইন ভঙ্গ করলে প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লক্ষ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা গৃহীত প্রকল্পের ক্ষেত্রে অবিলম্বে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ না করলে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ১ (এক) লাখ টাকা, অনধিক ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
এই আইন অনুসারে কোনো এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থা (ইকো সিস্টেম) সংকটাপন্ন হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা সে এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করতে পারে। এ রকম কোনো স্থানে নিষিদ্ধ কর্ম বা প্রক্রিয়া চালু রাখা বা শুরু করলে প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ (দুই) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন ২ (দুই) বছর, অনধিক ১০ (দশ) বছর কারাদণ্ড বা অন্যূন ২ (দুই) লাখ টাকা, অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
পরিবেশ আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি যদি কোম্পানি বা সমিতি বা সংঘ হয়, তাহলে সেই কোম্পানি বা সমিতি বা সংঘের মালিক, অংশীদার, স্বত্বাধিকারী, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার, ম্যানেজার, সচিব বা প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। অপর দিকে সরকারের কোনো বিভাগ বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় সরকার সংগঠন বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা যদি পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে সরকারের সেই বিভাগ বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় সরকার সংগঠন বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার, ম্যানেজার, সচিব বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
আইনের দুর্বলতা
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, পরিবেশ আদালতে সাধারণ মানুষ অথবা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সরাসরি মামলা করতে পারে না। কেউ মামলা করতে চাইলে প্রথমে পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানাতে হয়। প্রতিকার না পেলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারেন। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের ব্যত্যয় করছেন, তাহলে ক্ষতি নির্ধারণ করে তা পরিশোধের নির্দেশ দিতে পারবেন। ক্ষতিপূরণ না দিলে মহাপরিচালক আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারবেন। এ নির্দেশ অমান্য করলে ফৌজদারি মামলা করা যাবে। সরাসরি মামলার সুযোগ না থাকাটা এই আইনের একটি দুর্বলতা বলে মনে করছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে তারা আইনটি সংশোধনের দাবি করেছে।