প্রবাসী শ্রমিকরা দিচ্ছে বেশি, পাচ্ছে কতটা

0
103
তাসনিম সিদ্দিকী

এখন পর্যন্ত প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষায় যে টাকা খরচ করা হচ্ছে, তা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের টাকা। অর্থাৎ কল্যাণ বোর্ডে জমা করা শ্রমিকের টাকা খরচ করা হচ্ছে শ্রমিকের জন্য। কিন্তু জাতীয় বাজেটে শ্রমিকের জন্য বরাদ্দ কোথায়? এত রেমিট্যান্স আসছে; কিন্তু রেমিট্যান্স পাঠানো শ্রমিকের জন্য বাজেট কোথায়? প্রবাসী শ্রম অধিকার রক্ষায় শুধু কল্যাণ বোর্ড থেকে নয়, সরকারের বাজেট থেকে কর্মীদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।

বিদেশে অভিবাসী কর্মীর নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সংস্থার পদক্ষেপ প্রয়োজন। শুধু নিয়োগকারী দেশের সরকার নয়, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়বদ্ধ করতে হবে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা রক্ষায় কর্মপরিবেশ মোটামুটি ঠিক করেছে। কিন্তু বাংলাদেশি কর্মীরা যাচ্ছেন ছোট ছোট কারখানায় বা বাসাবাড়ির কাজে। কিংবা মরুভূমিতে উট চরাতে। এমন বিক্ষিপ্ত কর্মক্ষেত্রের কর্মীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তা করতে এসব ছোট প্রতিষ্ঠানের মালিকদের শাস্তির আওতায় আনার দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। এর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে যে পরিমাণ টাকা খরচ করতে হবে, তার বরাদ্দ তো দেওয়া হয় না। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো দেশ থেকে যেসব রাষ্ট্রে কর্মী যাচ্ছে, সেখানে মানবাধিকারের খুব একটা পরোয়া নেই। গণতন্ত্রও তেমনভাবে নেই। ফলে চাকরিচ্যুতি, বেতন না পাওয়া এবং সব শেষে কর্মীদের মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে। গত ছয় বছরে যত বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে মারা গেছেন, তাঁদের ৩১ শতাংশের অপমৃত্যু হয়েছে। সৌদি আরবে মোট মৃত্যুর ২৭ শতাংশ খুনের শিকার। এই লক্ষণগুলো বলে, শ্রমিকের অধিকার অরক্ষিত।

প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ কী করতে পারে? জনশক্তি রপ্তানিতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) বা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়। বেশিরভাগ নিয়োগকারী দেশকে এমওইউ মেনে চলতে বাধ্য করতে পারে না বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুফল বাংলাদেশ পায় না। নিয়োগকারী দেশ যেভাবে চায়, সেভাবেই চুক্তি হয়। ফলে শ্রমিকের অধিকার রক্ষা হয় না। তাই গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশেনের মতো বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আরও বেশি সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। সেখানে বাংলাদেশি কর্মীদের মৃত্যুর বিষয়টি এখনও আনা হয়নি। আগামী সম্মেলনে তা তোলা প্রয়োজন।

আগে কর্মীরা পাসপোর্ট নিজের কাছে রাখতে পারতেন না। গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশনে বিষয়টি আসার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মী এখন পাসপোর্ট নিজের কাছে রাখতে পারছেন। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে।

কর্মী যে দেশে যাচ্ছে, সেখানে আদৌ চাকরি রয়েছে কিনা, বেতনের নিশ্চয়তা রয়েছে কিনা, তা দূতাবাসের মাধ্যমে যাচাই করা কঠিন। কিন্তু কঠিন বলে যাচাই বাদ দেওয়া যাবে না। সরকারকে কোনো পদ্ধতি বের করতে হবে। ভারত প্রবাসী নাগরিকদের কাজে লাগাচ্ছে কর্মীর চাহিদাপত্র যাচাইয়ে। যাচাই সম্ভব না হলে কর্মী পাঠানো কমিয়ে দিক সরকার। খারাপ অভিবাসনের চেয়ে কম কর্মী যাওয়া ভালো।

সৌদিতে আবিরন বেগম নামে এক বাংলাদেশি কর্মীকে হত্যার বিচার করে খুনিদের সাজা দিয়েছেন দেশটির আদালত। তার মানে, আইনি লড়াইয়ে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যার অধিকার খর্ব হয়েছে, তাঁকে বিচার পেতে বিদেশে কিছুদিন থাকতে হয়। এর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। সে কারণে কর্মীরা মামলা করে না বা করতে চায় না। আমরা বলেছি, কিছু কিছু ঘটনার ন্যায়বিচারের জন্য অভিবাসীর যদি বিদেশে থাকার প্রয়োজন হয়, সেই ব্যবস্থা সরকারেরই করা উচিত।

আগে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ আদায়ের পুরো প্রক্রিয়া সরকারিভাবে করা হতো। এতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এর সুযোগ নিচ্ছে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা এবং বেসরকারি আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্ষতিপূরণের টাকার অর্ধেকের বেশি তারা নিয়ে নিচ্ছে। ক্ষতিপূরণ আদায় সরকারকেই করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে আহত হওয়া, শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোতেও সরকারকে লড়াই করতে হবে। সব ঘটনায় হয়তো লড়াই করা যাবে না। তাই একটি লক্ষ্য তৈরি করা উচিত, কোন দেশে বছরে কতগুলো মামলা করা হবে। মোদ্দা কথা এই, প্রবাসী শ্রমিকরা এত এত দিচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে কই? কী পাচ্ছে আর কতটাইবা পাচ্ছে?

বিদেশ থেকে আসা অনেক লাশের ক্ষেত্রে বলা হয়, কর্মী আত্মহত্যা করেছেন। আসলে এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই হত্যা। তাঁরা বিদেশ গিয়ে দু’পক্ষের সংঘাতের মধ্যে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে কর্মী জিম্মি হন অপহরণকারীদের কাছে। অপহরণকারীরা কর্মীকে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে। অনেক কর্মী বিদেশ যেতে মরিয়া থাকেন। সে কারণেই শ্রম অধিকার রক্ষা করা হয় না– এমন খারাপ যেসব চাহিদাপত্র আসে, তাতে কর্মী নিয়োগ হয়। জনশক্তি রপ্তানিকারক এবং নিয়োগকারী উভয় দেশে রিক্রুটিং এজেন্সির পরও কিছু ধাপ বা মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগকারী দেশও এসব মধ্যস্বত্বভোগীকে নির্মূল করতে চায়। এদের আইনের আওতায় আনতে হবে। নয়তো খারাপ চাহিদাপত্র আসতেই থাকবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত হবে না।

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.