নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। গতকাল বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করে নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানান তিনি। এদিন সকালে রাষ্ট্রদূত ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে অপ্রীতিকর পরিস্থির সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষের কথা তুলে ধরেন পিটার ডি হাস।
গতকাল সকাল ৯টায় রাজধানীর শাহীনবাগে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ২০১৩ সালে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় যান রাষ্ট্রদূত। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। তবে সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন ‘মায়ের কান্না’ নামে আরেকটি সংগঠনের সদস্যরা। সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে তাঁরা স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় কিছুটা ধাক্কাধাক্কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তাজনিত কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে মায়ের ডাকের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে বের হয়ে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এর পর দুপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন তিনি।
মায়ের ডাকের সঙ্গে বৈঠকের সময় পিটার ডি হাসের সঙ্গে ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বাংলাদেশ ডেস্কের কর্মকর্তা লিকা জনসন। সুমনের পরিবারের সদস্যসহ মায়ের ডাকের বেশ কয়েকজন সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গতকাল সকালে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র জেফ রাইডেনাওয়ার বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা নিরাপত্তাজনিত কারণে বৈঠক আগেই শেষ করেছেন। আমরা বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলে তুলব।’
বিএনপি নেতা সুমনের বাসায় ‘মায়ের কান্না’ সংগঠন ৪৫ বছর আগে সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মার্কিন দূতের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পৌঁছার পরপরই কথা বলতে চান। পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে রাষ্ট্রদূত সকাল ৯টা ৫ মিনিটে সুমনের বাসায় প্রবেশ করেন। এ সময়েও সেখানে ওই সংগঠনের সদস্যরা অবস্থান নিতে থাকেন। এতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে- এমন আশঙ্কায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাড়াতাড়ি কর্মসূচি শেষ করে ফিরে যান। প্রায় ২৫ মিনিট পিটার ডি হাস সুমনের বাসায় অবস্থান করেন।
বের হয়ে যাওয়ার সময়েও মায়ের কান্না সংগঠনের সদস্যরা আবারও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলতে চান এবং স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। এমনকি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি। তবে মায়ের কান্না সংগঠনের একজন সদস্য রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে স্মারকলিপির একটি কপি পৌঁছে দিতে সক্ষম হন বলে জানা গেছে।
গতকাল বিকেলে মার্কিন দূতের সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত জরুরি ভিত্তিতে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি রাজধানীর একটি বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিল। তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁকে বলেছেন দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে। না হলে ওরা গাড়ি ঘিরে ফেলবে। এ ঘটনায় মার্কিন দূত খুবই অসন্তুষ্ট। মার্কিন দূতকে জানিয়েছি, আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের। মার্কিন দূত অধিকতর নিরাপত্তা চাইলে সরকার সে ব্যবস্থা করবে।
এদিকে কী হয়েছিল- জানতে চাইলে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, রাষ্ট্রদূতের আগমনের সংবাদ পেয়ে আধা ঘণ্টা আগেই মায়ের কান্না সংগঠনের সদস্যরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান। কিন্তু এভাবে একজন রাষ্ট্রদূতের রাস্তা আটকে কেউ দাঁড়াতে পারে না- সেটা হয়তো তাঁরা জানেন না। তাঁরা আগে থেকে কোনো শিডিউলও নেননি। কিন্তু বাজেভাবে তাঁকে রাস্তায় আটকানোর চেষ্টা করা ঠিক হয়নি। তাঁদের বাসার সামনের গেটেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ওই সংগঠনের লোকজন। এখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজনও ছিল। পুলিশও ছিল। কিন্তু তারা ছিল নির্বিকার।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৮ সালের আগস্টে ঢাকার মোহাম্মদপুরে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছিল এক দল সশস্ত্র যুবক।
সাজেদুল ইসলাম সুমন ঢাকা মহানগর ৩৮ (বর্তমান ২৫) নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি নিখোঁজের পর তাঁর বোন সাজিদা ইসলাম তুলি গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। জাতিসংঘের তালিকায় গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের মধ্যে সাজেদুল ইসলাম সুমনের নামও রয়েছে।
মার্কিন দূতের সঙ্গে বৈঠক বিষয়ে জানতে সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে গুমের শিকার পরিবার নিয়ে কাজ করছেন। এটাকে তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবেও তুলে ধরেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁদের কাছে সর্বশেষ অবস্থান এবং কী করতে চাই, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। তাঁরাও বিস্তারিতভাবে গুমের শিকার পরিবারের মানবেতর জীবন, তাঁদের ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন।
মায়ের ডাক সংগঠনের সদস্যরা বলছেন, মূলত তাঁদের নির্ধারিত কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করতেই অযাচিতভাবে মায়ের কান্না সংগঠন কাজ করেছে। ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের পাল্টা হিসেবে সরকারের সমর্থন নিয়ে তাঁরা ‘মায়ের কান্না’ নামের সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন গুমের শিকার ঘটনাকে আড়াল করতে জিয়াউর রহমানের আমলে সংঘটিত ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের নামে বিমানবাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য গুমের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের কান্না’। সম্প্রতি সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। তাঁরা জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। ৪৫ বছর আগের গুমের ঘটনা ও সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেন সংগঠনের সদস্যরা।