পরপর দুই বছর জুলাইয়ে বৃষ্টি কম, কিসের ইঙ্গিত

0
131
গরমে হাসফাঁস অবস্থা । একটু শীতল হতে মাথায় পানি ঢালছেন এক রিকসা চালক

দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। কিন্তু চলতি বছর এবং গত বছরও এ মাসে গড় বৃষ্টির অর্ধেকও হয়নি। গত বছরের জুলাইয়ে ৩৫ বছরের ইতিহাসে কম বৃষ্টি হয়েছিল। এবার সামান্য বাড়লেও তা অর্ধেকেরও কম।

শুধু জুলাই না, আগস্ট মাসেও বৃষ্টি কমে আসছে। এ দুই মাসে বাড়ছে তাপমাত্রা। কয়েক বছর ধরেই আবহাওয়ার এলোমেলো স্বভাব দেখছেন আবহাওয়াবিদেরা। জুলাই মাসের এই অস্বাভাবিক কম বৃষ্টি সেই বৈরী চরিত্রের প্রতিফলন বলে মনে করছেন তাঁরা। এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতার মিলও খুঁজছেন তাঁরা।

জলবায়ু বিশারদ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দুই বছরের হিসাব ধরে বড় কোনো সিদ্ধান্তে আসা না গেলেও কিছু পরিবর্তন বড় আকারেই দেখা দিচ্ছে। বৃষ্টির ধরন পাল্টে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ঋতুভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের কিছু পরিবর্তন হতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে দেশের কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের ওপর।

জুলাইয়ে কত কম বৃষ্টি হলো

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। এর পরিমাণ ৫২৩ মিলিমিটার। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয় জুন মাসে, প্রায় ৪৬০ মিলিমিটার। আগস্টে গড় বৃষ্টির পরিমাণ ৪২০ মিলিমিটারের বেশি।

তবে গত বছর দেশে জুলাই মাসে প্রায় ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়। এ বছর জুলাইয়ে গড় বৃষ্টির চেয়ে ৫১ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।

গত বছরের জুলাইয়ের কম বৃষ্টি ৪১ বছরের মধ্যে ছিল সর্বনিম্ন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপাত্ত তুলে ধরে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, দুই বছরের হিসাবে জুলাইয়ে কম বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর ক্ষেত্রে এত কম সময়ের উপাত্ত ধরে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। কিন্তু হঠাৎই এত কম বৃষ্টি এবং আবহাওয়ার আনুষঙ্গিক নানা বৈশিষ্ট্য দেখে বলা যায়, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি অনিবার্য প্রভাব পড়ছে। এ বছর বিশ্ব উষ্ণতম জুলাই মাস দেখেছে। এল নিনোর প্রভাবে এটা হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব দেখা গেছে।

চলতি বছরের জুলাই মাস ছিল ইতিহাসের উষ্ণতম মাস। সম্প্রতি এমন তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ)।

বৈশ্বিক উপাত্ত তুলে ধরে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের নানা প্রান্তে এ বছরের জুলাই মাসে তীব্র গরম ছিল। চীনের জিনজিয়ান প্রদেশের সানবাও শহরে তাপমাত্রা ছিল ৫২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ওই অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ২০১৭ সালে, ৫০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যুক্তরাষ্ট্রের ফোনিক্সে এবার ৪৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল রেকর্ড। ডেথ ভ্যালিতে ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে, যা ছিল সর্বকালের রেকর্ড। বৈশ্বিক এই বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাব সর্বত্রই আছে।

বছরজুড়েই বৈরী প্রকৃতি

গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুন—এই মোট ১২ মাসের মধ্যে ৮ মাস কোনো না কোনোভাবে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি দেখা গেছে। মাত্র ৪ মাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল।

গত বছরের জুন মাসে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিল সিলেট অঞ্চলে। এতে বন্যা হয় সিলেট ও সুনামগঞ্জে। এর পরের মাস জুলাইয়ে আবার ৫৮ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়। আবার বৃষ্টি কম হয়েছে আগস্টে ৩৬ শতাংশের বেশি। সেপ্টেম্বরে স্বাভাবিক ছিল। অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে পাঁচ গুণ বৃষ্টি বেশি হয়েছিল। নভেম্বর ও ডিসেম্বর স্বাভাবিক থাকলেও অস্বাভাবিক আচরণ করে জানুয়ারি মাসে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একদিনে (৩ জানুয়ারি) সারা দেশে ২ থেকে ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে গেছে। এটা স্বাভাবিক অবস্থা ছিল না। ফেব্রুয়ারিতে অস্বাভাবিক কম বৃষ্টি হয়েছে এবার। মার্চ মাসে আবার ৭৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলছিলেন, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ ছিল এবার। কয়েক বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। এবার জুলাই মাসেও একটা বড় সময় ধরে তাপপ্রবাহ ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বৃষ্টির ধরনে একটা পরিবর্তন আসছে। মৌসুমি বায়ুর প্রবেশে দেশে বড় ধরনের বৃষ্টি হয়। সাধারণত ৩১ মের মধ্যে দেশে মৌসুমি বায়ুর প্রবেশ ঘটে মূলত কক্সবাজারের টেকনাফ অঞ্চল দিয়ে। এবার মৌসুমি বায়ু এসেছে ৮ জুনের দিকে। গত বছরও দেরিতে এসেছিল এ বায়ু। বৃষ্টি ও তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ। তিনি চার দশকের বৃষ্টি ও তাপমাত্রার পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই আবহাওয়াবিদের বক্তব্য, ‘যে প্রবণতা দেখছি, তাতে বর্ষার যে মূল সময়, তখন বৃষ্টি কমে যেতে পারে। প্রাক্‌-মৌসুমি বৃষ্টি হয়তো ভবিষ্যতে তা বেড়ে যেতে পারে। আবার মৌসুমি বায়ুর পরবর্তী সময়ে তা আবার বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ বৃষ্টির ধরনে একটা পরিবর্তন আসছে। এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। জুলাইয়ে এত কম বৃষ্টি সেটির লক্ষ্মণ।’

জুলাইয়ের কম বৃষ্টিতে প্রভাব কী

দুই বছর ধরে জুলাই মাসে বৃষ্টির যে হাল দেখছেন, আবদুল আজিজ আগে তা দেখেননি। উত্তরের জনপদ নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার হুদ্রাকুড়ি গ্রামে বাড়ি এ কৃষকের। তিনি এখন আমন ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত। তবে এ কাজে এবার অন্তত সাধারণ সময়ের চেয়ে ১৫ দিন দেরি হয়ে গেছে। সাধারণত জুলাই মাসের ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে রোপা আমনের চারা লাগানো শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এবার বৃষ্টি হয়নি। তাতেই দেরি। তবে অপেক্ষা আর না করে সেচ দিয়ে খেত প্রস্তুত করে ফেলেছেন আজিজ। তাতে খরচ হয়েছে বেশি। গতবারও এমনটাই হয়েছিল। কারণ, আমনের চারা রোপণের সময় সাধারণত সেচ লাগত না আগে। কিন্তু গত দুই বছরের জুলাইয়ের কম বৃষ্টি তা আর হতে দিচ্ছে না।

আবদুল আজিজ বলছিলেন, ‘এবার পিছায়ে গেলাম। গেল বছরও এমন হছিল। আমনে দেরি হওয়ায় রবিশস্য দেরিতে করা ল্যাগবে।’

খেত থেকে আমন উঠতেই আলু ও শর্ষে চাষে লেগে যান কৃষকেরা। আবদুল আজিজের মতো কৃষকদের ভাবনা, জুলাইয়ের কম বৃষ্টি গতবারের মতো এবারও সমস্যায় ফেলবে। বিশেষ করে রবিশস্যের ফলনে।

জুলাইয়ে কম বৃষ্টিতে কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নওগাঁ জেলার প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ কে এম মনজুরে মাওলা। সেগুলো হলো, দেরিতে রোপা আমন বোনা, সেচের জন্য বেশি অর্থের প্রয়োজন এবং দেরিতে ফসল বোনার জন্য রবিশস্যের ওপর প্রভাব। এই কৃষিবিদ প্রথম আলোকে বলছিলেন, বৃষ্টি না হওয়ার জন্য কৃষকেরা বাধ্য হয়ে সেচ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে। যেটা আগে একেবারেই ছিল না।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফকির আজমল হুদা বাংলাদেশের কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে পিএইচডি করেছেন। জুলাইয়ে কম বৃষ্টি এবং চলতি বছরে প্রচণ্ড তাপের কারণে কৃষির ওপর প্রভাব সম্পর্কে অধ্যাপক আজমল হুদা বলেন, জুন ও জুলাইয়ে আমন ধানের বীজ রোপণের সময়। সময়টায় বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে এবার অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে সেচের কাজে। এর সার্বিক প্রভাব পড়বে উৎপাদন ও দামে।

কৃষির ওপর সরাসরি প্রভাবের পাশাপাশি জুলাইয়ে কম বৃষ্টি প্রাণিসম্পদের ওপর এর প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন ফকির আজমল হুদা। তিনি বলছিলেন, গরমকালে মাছির উপদ্রব বাড়লে গরুর লাম্মি স্কিন (এলএসডি) রোগ ছড়ায়। কিন্তু এখন জুলাইয়ে কম বৃষ্টি এবং প্রচণ্ড গরমে এ রোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এলএসডি আক্রান্ত গরুর সংখ্যা আট হাজারের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগ ছড়িয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। চলতি বছরের জুলাই মাসে বিভাগ অনুযায়ী সবচেয়ে কম, অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে।

চট্টগ্রামে অতি কম বৃষ্টির সঙ্গে এলএসডির ব্যাপকতার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে মনে করেন অধ্যাপক ফকির আজমল হুদা। তিনি বলেন, এ বছর এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড গরম ছিল। এপ্রিলে প্রাকৃতিক মাছ ডিম দেয়। কিন্তু এবার সেটা দেরি হয়ে গেছে। বৈরী আবহাওয়া এর কারণ।

জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

বর্ষার সময় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি জনস্বাস্থ্যের নানা দিকে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। তিনি বলছিলেন, বর্ষার সময় তাপ বাড়লে ডায়রিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েডের মতো পানিবাহিত রোগ বেড়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে এসবের প্রবণতা বেড়েছে।

এ বছর বাংলাদেশসহ দেশের কয়েকটি দেশে বেড়েছে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব। প্রচণ্ড তাপ এবং সেই সঙ্গে বেশি আর্দ্রতায় ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করে বলে জানান মুশতাক হোসেন। এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলছিলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের এসব প্রভাবকে মাথায় নিয়ে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনা দরকার।

অতি তাপ এবং বৃষ্টির সময় কম বৃষ্টির প্রভাবে টাইফয়েডসহ নানা রোগ বাড়ছে বলে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘পরিবেশটা ভিন্ন রকম হয়ে যাচ্ছে। অতি গরম আবার বৃষ্টির সময় বৃষ্টি নেই। এর ফলে পানিবাহিত রোগী এখন বেশি দেখছি। এর পাশাপাশি শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগও বাড়ছে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.