রবীন্দ্রসংগীতের বরেণ্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে এ বছর ‘পদ্মশ্রী’ পদকে ভূষিত করেছে ভারত সরকার। ২২ এপ্রিল সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। পদকপ্রাপ্তির পর দেশে ফিরে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিন্দ্য মামুন।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা:এই পত্রিকার সঙ্গে আমার অন্যরকম সম্পর্ক। গোলাম সারওয়ার ভাই যখন বেঁচে ছিলেন, তখন সব কিছুতেই আমাকে রাখতেন, আমাকে ডাকতেন। তখন থেকেই পত্রিকাটির সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের জেরেই ঢাকায় ফিরে পত্রিকার মধ্যে প্রথম ইন্টারভিউটা দিচ্ছি।
পদ্মশ্রী পাওয়ার অনুভূতি কেমন?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: যখন শুনেছি, পদ্মশ্রী পাচ্ছি, তখনই বেশ সম্মান ও গৌরব অনুভব করেছি এবং আবেগতাড়িতও হয়েছি। ওপরওয়ালার অনেক রহমত আমার ওপর। আমি সামান্য এবং সাধারণ মানুষ। শুদ্ধ সংগীতচর্চায় জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। বেশি কিছু আর কী করতে পেরেছি? কত মানুষ কত ভালো কাজ করে। আমি একটু গান করি; হয়তো গানটা মানুষের ভালো লাগে। সে জন্য মানুষ সম্মান করে। যে স্বীকৃতিটা পেলাম, সেটার যোগ্য কিনা জানি না। এই স্বীকৃতি আমাকে আরও দায়বদ্ধ করল।
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে পুরস্কার নেওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত ছিলেন। আসলে এটি ছিল একটি পোশাকি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের রিহার্সাল করতে হয়েছে। ভারতে আমার নিয়মিতই যাওয়া হয়। এই প্রথম রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার ব্যাপারটা আলাদা এক অভিজ্ঞতা। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নেওয়া– সবকিছু মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার ঘটে গেল জীবনে।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কি আলাপের সুযোগ হয়েছে?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: রাষ্ট্রপতির সঙ্গে খানিকটা কথা হয়েছে। যখন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রতি এসে কথা বললেন, তখন আমি বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তখন রাষ্ট্রপতি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, আচ্ছা– বহুত আচ্ছা।’ সে সময় বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে অন্যরকম এক অহংকারের জায়গা তৈরি হলো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। তিনি যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, সে সময় তাঁর সৌজন্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলাম। শান্তিনিকেতনেও দেখা হয়েছে। দেখা মাত্রই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ক্যায়সা হ্যায় রেজওয়ানা জি…’? মূলত সৌজন্যবশত জিজ্ঞেস করেন। আমিও তার উত্তর দিই। এ ছাড়া আর তেমন কথার সুযোগ হয়নি।
পদ্মশ্রী গ্রহণের বিষয়টি আপনার পরিবার-সহকর্মীরা কীভাবে উদযাপন করছেন?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: আমার পরিবার তো ভারতে আমার সঙ্গেই ছিল। তারা পুরো সময়টাতেই বিষয়টি উদযাপন করেছে। দেশে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে এলাম। তারাও যথেষ্ট সম্মান দিল। দিল্লির হোটেল থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সম্মানিত অতিথি হিসেবেই তারা নিয়ে এসেছে। সব জায়গায় আমাদের পদ্মশ্রী অ্যাওয়ার্ডি বলছিল। কেক কাটল। তাদের এই ব্যাপারটি আমার কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। দৃশ্যটি দেখে হয়তো আশপাশের সবাই ভাবছিলেন, কী একটা ভিআইপি যাচ্ছে! যার সামনে-পেছনে ৮-১০ জন মানুষ। আসলে তো যাচ্ছিলাম আমি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা (হাসি)। সবকিছুতে একটা জ্বলজ্বলে অনুভূতি হয়ে রয়েছে। দেশে আসার পরও সবার উদযাপনে আমি মুগ্ধ।
পদ্মশ্রী পদকপ্রাপ্তিতে শান্তিনিকেতনের কতটা প্রভাব রয়েছে?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: পুরোটাই শান্তিনিকেতনের প্রভাব। আমি আজকে যা, এই রবীন্দ্র ভাবনা, রবীন্দ্র আদর্শ– এর ভিত্তিটাই তো গড়ে দিয়েছে শান্তিনিকেতন। আমার হাতেখড়িই তো সেখানে। সেখানকার পরিবেশ, প্রকৃতি, গুরুদের সান্নিধ্য, জীবনযাপন, রবীন্দ্র আদর্শের মধ্যে সময় কাটানো ও বেড়ে ওঠা– সব কিছু মিলিয়েই তো আজকের আমি।
শান্তিনিকেতনীয় বা এই রবীন্দ্র প্রভাব দেশে কতটা ছড়িয়ে দিতে পারছেন?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: খুব একটা পারা যাচ্ছে না। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির অনেক বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। সেখানকার জীবনযাপন, গুরুদের জীবনচর্চা অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের দেশে সম্পূর্ণ একটা নাগরিক জীবন। পুরো বস্তুজগৎকে কেন্দ্র করে এই নাগরিক জীবন ঘূর্ণায়মান। জন্মের পর থেকে বাচ্চারা বেড়ে ওঠে শহুরে একটা ভাবের মধ্যে। বস্তুজগতের চাওয়া-পাওয়া, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ তাদের মধ্যে একটা সময় গ্রাস করে। এক সময় ভাবতে শুরু করে– আমাকে পরীক্ষায় ভালো করতে হবে; বিদেশ যেতে হবে; বড় চাকরি করতে হবে; অনেক টাকা জোগাড় করতে হবে; বিশাল বড় বাড়িতে থাকতে হবে; দামি গাড়ি কিনতে হবে। এগুলো তো নাগরিক জীবনের শর্ত। এ থেকে ওদেরকে যে বের করে নিয়ে আসব, তার কোনো উদাহরণ নেই। আর শান্তিনিকেতন হচ্ছে পুরোটাই একটা উদাহরণ।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা সেন থেকে আপনি দীক্ষা নিয়েছেন। ওই সময়ের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: তখনকার পুরোটা সময়ই তো আমার সামনে। তাদের দীক্ষা নিয়েই আজকের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। কাজেই তাদের সঙ্গে কাটানোর কোনো বিশেষ সময় নয়, পুরোটা সময়ই আমার সামনে স্পষ্ট ও বিদ্যমান। কয়েক মিনিটের সাক্ষাৎকারে তা বলা সম্ভব হবে না। আমি যখন কোনো কিছু করতে যাই, সেই সময় তাদের দীক্ষাটা সামনে চলে আসে। শুধু বলব, আমি অনেক ভাগ্যবান, তাদের মতো গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছি। এখন আমি ছেলেমেয়েদের যতটুকু শেখাচ্ছি বা বলছি, তা তো সব তাদের আদর্শের ভেতর দিয়েই।
বাংলাদেশে শুদ্ধ সংগীতচর্চা নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: বাংলাদেশে শুদ্ধ সংগীতচর্চা বা রবীন্দ্রচর্চা, যা-ই বলেন, তা কমে যাচ্ছে। একেবারেই যে নেই, তা বলব না। এখনও অনেক ওস্তাদ রয়েছেন, গুরু রয়েছেন। তারা শুদ্ধ সংগীতচর্চায় নিমগ্ন। চর্চা যদি আরও একটু বাড়ানো যায়, সেটা ছেলেমেয়েদের জন্য শুভকর হবে। তবে কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটা আমিও জানি না। কারণ প্রযুক্তির দিকে আমরা ডুবে যাচ্ছি। গানবাজনাটাও এখন হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর।
শুদ্ধ সংগীতের গুরুজন সাদি মহম্মদ মারা গেলেন। আপনারা একসঙ্গে শান্তিনিকেতনেও পড়েছেন। তাঁর মৃত্যুর কী কারণ বলে মনে করেন?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: সাদির এভাবে চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। মানুষের মনে যে কী কাজ করে! বিশেষ করে শিল্পীদের মনের মাঝে যে কী কাজ করে, এটা বলা মুশকিল।