পড়া শেষ না করেও ভারতের সর্বকনিষ্ঠ শতকোটিপতি অলক পান্ডে, কীভাবে তাঁর এই উত্থান

0
17
অলক পান্ডেফিজিকসওয়ালার ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

শিক্ষাপ্রযুক্তি খাতে ভারতে নতুন দুই উদ্যোক্তা শতকোটিপতি হয়েছেন। মঙ্গলবার অনলাইন শিক্ষা কোম্পানি ফিজিকসওয়ালা ভারতের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ তালিকাভুক্তির মধ্য দিয়ে কোম্পানির দুই কর্ণধার শতকোটিপতি হয়েছেন।

কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী অলক পান্ডে ৩৩ বছর বয়সে এখন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ শতকোটিপতি। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করেননি। সেই সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার প্রতীক মহেশ্বরী ৩৭ বছর বয়সে শতকোটিপতি হয়েছেন। তিনি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। খবর ফোর্বস

এ কোম্পানির জন্ম ২০২০ সালে। চিকিৎসাবিদ্যা ও প্রকৌশল ভর্তি পরীক্ষার কোচিংয়ের মধ্য দিয়ে এ কোম্পানির যাত্রা শুরু। এই দুই শতকোটিপতি অবশ্য এর আগে থেকেই শিক্ষা খাতে কাজ করছিলেন। অলক পান্ডে আগে থেকেই নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন। তিনি ফিজিকসওয়ালা অলক পান্ডে নামে পরিচিত। ২০২০ সালে তিনি প্রতীকের সঙ্গে যৌথ অংশীদারির মাধ্যমে এ কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন। প্রতীকের ছিল পেন পেনসিল নামে নিজস্ব ই-লানিং অ্যাপ। তাঁদের উভয়ের লক্ষ্যই ছিল একই—সুলভ মূল্যে শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করা। এ অভিন্ন লক্ষ্য থেকে এই দুই কোম্পানি একীভূত হয়।

দিল্লির পার্শ্ববর্তী নয়ডাভিত্তিক এ কোম্পানি আইপিওতে নির্ধারিত মূল্যের ৪২ শতাংশ প্রিমিয়ামে শেয়ারবাজারে আত্মপ্রকাশ করেছে। অনলাইনের পাশাপাশি দেশজুড়ে বিস্তৃত কেন্দ্রের মাধ্যমেও কার্যক্রম পরিচালনা করে ফিজিকসওয়ালা। কোম্পানিটির দাবি, ভারতে যত পোস্টাল কোড আছে, তার প্রায় ৯৮ শতাংশ এলাকায় তারা পৌঁছে গেছে। তাদের পেইড অ্যাপে যুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এই আইপিও থেকে তারা ৩৯ কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে।

কোম্পানিটি এ পর্যন্ত দুটি বিনিয়োগ পেয়েছে—২০২২ সালে ৯০০ কোটি রুপি ও ২০২৪ সালে ১ হাজার ৮৬০ কোটি রুপি। এই দুই ধাপে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগকারী ওয়েস্টব্রিজ ক্যাপিটাল ও লাইটস্পিড ভেঞ্চার পার্টনার্স বিনিয়োগ করে।

জুন মাস পর্যন্ত ফিজিকসওয়ালার ২০০টির বেশি সক্রিয় ইউটিউব চ্যানেল ছিল। মোট গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ কোটি। সম্প্রতি কয়েক বছরে কোম্পানিটি ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করেছে। ২০২২ সালে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক স্টার্টআপ নলেজ প্ল্যানেট কিনে নেয়। তবে কত অর্থের বিনিময়ে এ কেনাবেচা, সে তথ্য অপ্রকাশিত। পরের বছর কেরালাভিত্তিক শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম জাইলেম লার্নিংয়ের ৫০ শতাংশ শেয়ার ৫০০ কোটি রুপিতে কিনে নেয় তারা। সেই সঙ্গে চলতি বছরের শুরুতে ভারতের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা করা একটি প্রতিষ্ঠানের ৪০ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণ করে তারা।

কে এই অলক পান্ডে ও প্রতীক মহেশ্বরী

অলক পান্ডে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ২০১৪ সালে বিনা মূল্যে পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাস নেওয়ার জন্য তিনি ইউটিউব চ্যানেল চালু করেন। চ্যানেলটির গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ।

ইকোনমিক টাইমসের তথ্যানুসারে, অলক পান্ডের বেড়ে ওঠা উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ছোট শহর প্রয়াগরাজে। ছোটবেলা থেকেই তিনি পাঠদান শুরু করেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াতেন। তিনি মিমে, কৌতুক ও ট্যাটুকে শিক্ষণ-উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সার্থকতা এতটাই ছিল যে ছাত্ররা তাঁর অন্ধ ভক্ত হয়ে যায়। তাঁর শরীরে বেশ কিছু ট্যাটু আছে—আলবার্ট আইনস্টাইনের মুখ থেকে শুরু করে গণিতের পাই প্রতীক পর্যন্ত। এসব ট্যাটু নিয়ে তিনি রীতিমতো গর্ব করেন।

প্রকৌশল পড়তে পড়তে তৃতীয় বর্ষেই পড়া ছেড়ে দেন অলক। এরপর তিনি নিজের শহর এলাহাবাদের এক কোচিং সেন্টারে পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম বেতন ছিল পাঁচ হাজার রুপি।

শিক্ষক হিসেবে যাত্রা শুরু করে ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে পরিচিত হন তিনি। ফলে তাঁর চোখের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। পড়াতে পড়াতে বুঝতে পারেন, নিজের বিষয়ে দক্ষতার পাশাপাশি একজন শিক্ষককে বর্ণময় ও একই সঙ্গে কঠোর হতে হবে। প্রকৌশলের পড়াশোনা শেষ না করা অলক এরপর ইউটিউবের দুনিয়ায় পা রাখেন। পরিচিত পেলেন সফল ইউটিউবার হিসেবে।

অন্যদিকে কোম্পানির কৌশলগত উদ্যোগ ও উদ্ভাবনের বিষয়-আশয় তদারক করেন প্রতীক মহেশ্বরী। তিনি যন্ত্রকৌশলে স্নাতক। ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটি-বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এই ডিগ্রি অর্জন করেন।

প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ১৭ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা আছে প্রতীকের। সেই আলোকে তিনি শিক্ষা খাতে বিপুল জ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিয়ে এসেছেন। ফিজিকসওয়ালার যাত্রা শুরুর পর থেকেই প্রতীক প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ফিজিকসওয়ালা দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে। ভারতের শিক্ষাপ্রযুক্তি বা এডটেক খাতে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন তিনি। ব্যবসায়িক মেধা কাজে লাগিয়ে তিনি প্রেপঅনলাইন, আই-নিউরন ও জাইলেম লার্নিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফিজিকসওয়ালার কৌশলগত অংশীদারি নিশ্চিত করেছেন। ফলে সাশ্রয়ী ও উচ্চমানের শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফিজিকসওয়ালার অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।

প্রতীকের দানধ্যানের অভ্যাস আছে। তিনি আশা দ্বীপ বিদ্যাশ্রমের মতো এনজিওর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। এই প্রতিষ্ঠান সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

সফলতা কি এত সহজ

কিন্তু জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া মানেই সফল হওয়া নয়। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো সাবেক এডটেক বিলিয়নিয়ার বা শিক্ষা খাতের শতকোটিপতি বাইজু রবীন্দ্রন। নিজের নামে ‘বাইজুস’ অ্যাপ চালু করে তিনি একসময় অদ্ভুত শিক্ষণপদ্ধতির মাধ্যমে গণিতের কঠিন ধারণা সহজ করে তুলেছিলেন। বাইজুস অবিশ্বাস্য গতিতে অনেক বড় হয়ে ওঠে—এতটাই যে শেষ পর্যন্ত নিজের ভারই তারা সামলাতে পারেনি। এখন প্রতিষ্ঠানটি আদালতের তত্ত্বাবধানে সম্পদ বিক্রির প্রক্রিয়ায় আছে।

যেটা হয়েছে সেটা হলো, ভারতের এই শিক্ষাবিষয়ক অ্যাপগুলো ঠিকঠাক দাঁড়ানোর আগেই অতি মূল্যায়িত হয়েছে। ফলে মাঝপথে এসে তারা হঠাৎই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাইজুস তো আছেই। এর সঙ্গে এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে, যেমন এডকম্প, এভেরন, এডসার্ভ সফটসিস্টেমস, কোর এডুকেশন অ্যান্ড টেকনোলজিস। আরেকটি উদাহরণ হলো ২০০৭ সালে এভারনের আইপিও। এই আইপিওর আবেদন পড়েছিল ১৪৫ গুণ বেশি। কিন্তু দ্রুত সম্প্রসারণের জন্য নেওয়া ঋণের ভারে প্রায় এক দশক আগে সব কটি প্রতিষ্ঠান ধসের মুখে পড়ে।

দ্বিতীয় ধাপে বাইজুস ও ইউএন একাডেমির মতো শিক্ষণ অ্যাপ এসেছে। এসব কোম্পানির মূল্যায়নও হয়েছে অনেক। ২০২২ সালে বাইজুসের মূল্যায়ন ২২ বিলিয়ন বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার পর্যন্ত ওঠে। এর পর থেকে তার পতন শুরু হয়। ২০২১ সালে ইউএন একাডেমির মূল্যায়ন ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৩৪০ কোটি ডলার পর্যন্ত ওঠে। এখন তার মূল্যায়ন ১০ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।

কিছু বিশ্লেষকের মতে, ফিজিকসওয়ালার যে সম্ভাবনা নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, বাস্তবেই তা পূরণ করার সক্ষমতা প্রতিষ্ঠানটির আছে। ডিজিটাল পরামর্শ ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ফাইভ এফ ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান গণেশ নটরাজন বলেন, ‘ফিজিকসওয়ালার দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠাতাদের সুপরিকল্পিত কৌশলে বাজার এক রকম আশ্বস্ত যে তাদের মূল্যায়ন বাস্তবসম্মত—অযৌক্তিক উচ্ছ্বাসের ওপর ভর করে এই মূল্যায়ন নয়। তারা যেটা করেছে সেটা হলো, কোচিং সেন্টার নেটওয়ার্ক ও অনলাইন শিক্ষণ কৌশলের সমন্বয় ঘটানো। এ ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.