পঞ্চগড়ে সংঘর্ষ-হামলার ঘটনায় আতঙ্ক কাটেনি, জানমালের নিরাপত্তা চান ক্ষতিগ্রস্তরা

0
121
পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র দেখছেন ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি। শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় আহম্মদনগর এলাকায়

বাড়িঘর ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।  শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় আহম্মদনগর এলাকায়

বাড়িঘর ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় আহম্মদনগর এলাকায়

আহম্মদনগর এলাকার বাসিন্দা গাজী সালাহউদ্দিন। স্ত্রী, চার সন্তানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যসংখ্যা ১৬। পঞ্চগড় চিনিকলে কর্মচারী ছিলেন। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সবাই জলসার স্থানে ছিলাম। সেখান থেকে বের হতে পারিনি। বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বজনেরা আসছিলেন। তাঁদের ব্যাগপত্রসহ বাড়ির সব জিনিস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

গাজী সালাহউদ্দিনের পুত্রবধূ নিশাত জাহান বলেন, ‘এতগুলো রোহিঙ্গা দেশে আশ্রয় পেল। আমরা পাব না কেন? আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। পোড়া জিনিসপত্রগুলো নিয়ে পথে বসে আছি। এটা কেমন ধর্ম পালন? মানুষ মেরে কি কায়েম করতে চাইছেন তাঁরা? বাড়িতে পড়ার মতো কোনো কাপড়চোপড় নেই। দুই দিন থেকে এক কাপড়েই আছি। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই না। আমরা আমাদের জানমালের নিরাপত্তা চাই।’

জলসাস্থলের পাশেই আহম্মদনগর উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষকেরা একটি কক্ষের বারান্দায় বসে আছেন। শ্রেণিকক্ষে ধোঁয়া উড়ছে। বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, শিক্ষক মিলনায়তন ও প্রধান শিক্ষকের কক্ষের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জুয়েল প্রধান বলেন, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় স্কুলে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় বিদ্যালয়ের পিয়ন ঘরে আটকা পড়েছিলেন। বিদ্যালয়ে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী আছে। শিক্ষক ও কর্মচারী আছেন ১৪ জন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছেন। অবশিষ্ট তিনটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে শিক্ষা অফিস।

একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় আহম্মদনগর এলাকায়

একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় আহম্মদনগর এলাকায়

জলসার আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়ক আহমদ সুমন তাঁর পুড়ে যাওয়া বাড়ি ঘুরে দেখান। শুধু ঘরের ইটের দেয়ালগুলো অবশিষ্ট আছে। বাকি সব ছাই হয়ে গেছে। সুমন বলেন, ‘বাড়িতে শুধু আগুন লাগানোই হয়নি। এর আগে হামলাকারীরা লুটপাটও করেছে। বাড়িতেই কিছুই নেই। আমার ১২ বছরের মেয়ে আর আরেক ভাইয়ের মেয়ের জন্য এবার জলসা উপলক্ষে একই জামা নিয়ে এসেছিলাম। আগুনে জামা দুটোই পুড়ে গেছে। বাচ্চারা তো কিছু বোঝে না। ওরা নতুন জামার জন্য কান্না করছে।’

হামলার ঘটনায় আজ বেলা তিনটায় জলসাস্থলে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে আহমদিয়া সম্প্রদায়। আর হামলায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নিহত তরুণ জাহিদ হাসানের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিহত আরেক তরুণ আরিফুর রহমানের লাশের জানাজা বিকেলে শহরের ইসলামবাগ এলাকায় হওয়ার কথা।

পঞ্চগড় শহরের পাশে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া জামাতের তিন দিনব্যাপী ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে গতকাল জুমার পর বেলা দুইটার দিকে শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সমবেত হন। সেখান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে করতোয়া সেতুর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের থামিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন।

আহম্মদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের শেণিকক্ষ,
 অফিস কক্ষসহ পুড়ে দেওয়া হয়েছে বেঞ্চ। শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় আহম্মদনগর এলাকায়

আহম্মদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের শেণিকক্ষ, অফিস কক্ষসহ পুড়ে দেওয়া হয়েছে বেঞ্চ। শনিবার দুপুরে পঞ্চগড় আহম্মদনগর এলাকায়

কিছুক্ষণ পর চৌরঙ্গী মোড়সংলগ্ন সিনেমা হল সড়ক থেকে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। বিক্ষোভকারীরা আহম্মদনগর এলাকায় গিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তত ২৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালান। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি হামলা চলে। একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়েন। এ ঘটনায় দুই তরুণ নিহত হয়েছেন। পুলিশের ৯ সদস্য, ২ সাংবাদিকসহ অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছেন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

বৃহস্পতিবার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে তেঁতুলিয়া-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখাসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা।

পুলিশ ও সংগঠনগুলো সূত্রে জানা যায়, আহম্মদনগর এলাকায় তিন দিনব্যাপী (শুক্রবার–রোববার) আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসার আয়োজন করা হয়। এ জলসা বন্ধ ঘোষণার দাবিতে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পঞ্চগড় শাখা, সম্মিলিত খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি, ইমাম-মোয়াজ্জিন কল্যাণ সমিতি, পঞ্চগড় কওমি ওলামা পরিষদ ও জাতীয় ওলামা মাশায়েক আইম্মা পরিষদের শত শত লোক মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ সময় শহরে প্রবেশের প্রধান সড়কগুলো বাঁশ ফেলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েন। পরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়।

রাজিউর রহমান রাজিউল ইসলাম

পঞ্চগড় থেকে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.