নৌকাডুবিতে স্বজনহারা তিন পরিবারের জীবনসংগ্রাম

0
103
পঞ্চগড়ে নৌকাডুবির ঘটনায় মারা যাওয়া সেন্টু বর্মণের মা পার্বতী রানী খেতে কাজ করছেন

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ্ব পার্বতী রানীর স্বামী অনেক আগেই মারা যান। আড়াই বছর আগে মারা যান শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে। ছেলে সেন্টু বর্মণ ছিলেন পার্বতীর অবলম্বন। সাত মাস আগে তিনিও নৌকাডুবিতে মারা যান। ঘরে সেন্টুর স্ত্রী ও দেড় বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সেন্টুকে হারিয়ে পরিবারটি এখন কষ্টে চলছে।

পার্বতীর বাড়ি বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলী গ্রামে। গ্রামটি থেকে করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটের দূরত্ব আধা কিলোমিটার। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে আউলিয়া ঘাট থেকে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা একই উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল।

যাত্রীদের অধিকাংশই মন্দিরটিতে মহালয়ার উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে কিছু দূর যাওয়ার পরই নৌকাটি ডুবে যায়। এই ঘটনায় ৭১ জনের লাশ উদ্ধার হয়। একজন এখনো নিখোঁজ। এই নৌকাডুবিতেই মারা যান সেন্টু (২৮)।

নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া জগদীশ চন্দ্র বর্মণের পরিবারের সদস্যরা
নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া জগদীশ চন্দ্র বর্মণের পরিবারের সদস্যরা

সম্প্রতি সেন্টুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের কড়া রোদে পার্বতী ঘরের কাছের মরিচখেতে নিড়ানি দিচ্ছেন। বললেন, ছেলে সেন্টুর মৃত্যুর পর তাঁকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। কৃষিকাজ থেকে বাজারসদাই—সবই তিনি করেন।

সেন্টুর স্ত্রী ভৈরবী রানী তাঁর দেড় বছরের মেয়ে জ্যোতিকে সামলানোর পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজ করেন।

পার্বতী জানালেন, নিজেদের এক বিঘাসহ অন্যের কাছ থেকে বন্ধক নেওয়া দেড় বিঘা জমিতে তিনি ধান, বাদাম, মরিচের আবাদ করেছেন। কৃষিকাজের পাশাপাশি ছাগল-মুরগি পালন করেন তাঁরা। এ দিয়েই সংসার চলছে। সেন্টুর মৃত্যুর পর সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছ থেকে মোট সাড়ে চার লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন। অনুদানের কিছু টাকা খরচ হয়েছে; বাকি টাকা সেন্টুর মেয়ে জ্যোতির ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে জমা রেখেছেন।

পার্বতীর ভাষ্য, আগে অন্যের জমিতে ঘর বেঁধে থাকতেন তাঁরা। সেন্টুর বয়স যখন ১০, তখন স্বামী নরেশ চন্দ্র বর্মণ মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে সেন্টু ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে পিংকীকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে চলতেন পার্বতী। সেন্টু বড় হলে মা-ছেলে মিলে কাজ করে জমি কিনে ঘর বাঁধেন। আড়াই বছর আগে শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে পিংকী মারা যান। বছর দুয়েক আগে ছেলে সেন্টুকে বিয়ে করান। সেন্টু দিনমজুরির কাজ করে একাই সংসার চালাতেন। পার্বতীকে আর কাজ করতে হতো না। এখন তাঁকে কষ্ট করে সংসার চালাতে হচ্ছে।

ফুলমতিদের চোখেমুখে অন্ধকার

সেন্টুদের বাড়ির সামনেই জগদীশ চন্দ্র বর্মণের বাড়ি। সমবয়সী সেন্টু-জগদীশ সম্পর্কে কাকা-ভাতিজা। নৌকাডুবির ঘটনায় জগদীশও মারা যান। তিনি কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করতেন। জগদীশের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারও দিশাহারা হয়ে পড়েছে।

জগদীশের স্ত্রী ফুলমতি রানী। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ছেলে কৌশিক বর্মণ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে প্রিয়ন্তীর বয়স আড়াই বছর। তাঁদের সঙ্গে থাকেন জগদীশের মা ননীবালা (৭৫)। জগদীশের বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন।

পরিবারটির এক বিঘা জমি আছে। আর আড়াই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতেন জগদীশ। এখন কৃষিকাজ করে সংসার চালান ফুলমতি। দুর্ঘটনার পর সহায়তা হিসেবে কিছু অর্থ তিনিও পেয়েছেন। এখন পরিবারটির বাজারসদাই করে দেন আত্মীয়স্বজন।
ফুলমতি বলেন, কপাল খারাপ হলে যা হয়, তা-ই হয়েছে তাঁর। এখন সংসার চালাতে চোখেমুখে অন্ধকার দেখেন তিনি।

দীপনের কাঁধে সংসারের ভার

করতোয়া নদীর এই জায়গায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছিল
করতোয়া নদীর এই জায়গায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছিল

একই নৌকাডুবিতে মারা যান ভূপেন নাথ বর্মণ (৪৫) ও তাঁর স্ত্রী রূপালী রানী (৩৬)। এই দম্পতির তিন ছেলে দীপন (১৮), পরিতোষ (১৩) ও দীপু (৪)। এখন এই তিনজনের অভিভাবক দাদা মদন বর্মণ (৮০) ও দাদি লক্ষ্মীবালা (৭০)।

ভূপেনদের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডোবা-ছত্রশিকারপুর গ্রামে। ভূপেন মানুষের বাড়িতে নানা কাজ করে সংসার চালাতেন। এ ছাড়া কৃষিকাজ করতেন তিনি।

সম্প্রতি এ পরিবারটির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দীপন মাঠে ধান কেটে কাঁধে করে বাড়ি ফিরছেন। তিনি বললেন, সংসারের ভারও এখন তাঁর কাঁধে।

দীপন স্থানীয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-ইন্দিরা মহাবিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে পড়ছেন। তাঁর ছোট ভাই পরিতোষ বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের মাড়েয়া জংলীপীর উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

দীপন বলেন, বাবার আয়ে তাঁদের পড়াশোনার খরচসহ সংসার চলত। এখন তিনি (দীপন) নিজেদের দেড় বিঘা জমিতে চাষাবাদ করেন। নৌকাডুবির ঘটনার পর বিভিন্ন জন সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। সেসব দিয়ে কোনোমতে তাঁরা চলছেন।
দীপনের দাদি লক্ষ্মীবালা বলেন, অল্প বয়সে ছেলে তিনটা মা-বাবা হারাল। তিনজনের দিকে তাকালে তাঁর বুক ফেটে যায়।

আউলিয়া ঘাটে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ

আউলিয়া ঘাটের অবস্থান পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নে। সম্প্রতি সরেজমিন আউলিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, করতোয়া নদীতে পানি খুবই কম। নদীর মধ্যে আড়াআড়িভাবে বাঁশ ও কাঠের একটি সাঁকো রয়েছে। এই সাঁকো দিয়ে স্থানীয় লোকজন নদী পার হচ্ছেন। জনপ্রতি টোল ১০ টাকা।

ঘাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি মো. মাসুম বলেন, পানি কম থাকায় চার মাস ধরে মানুষ সাঁকো দিয়ে নদী পার হচ্ছেন। এখন দিনে প্রায় ২০০ মানুষ এই সাঁকো ব্যবহার করেন। নদীর পানি বেড়ে গেলে তখন আবার নৌকায় পারাপার শুরু হবে।

নৌকাডুবির ঘটনার পর মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলেছিলেন, আউলিয়া ঘাটে দ্রুত সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হবে।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) পঞ্চগড় জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামছুজ্জামান আজ বুধবার বলেন, আউলিয়া ঘাটে ৮১০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ‘ওয়াই’ আকৃতির সেতু নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

দরপত্র মূল্যায়ন শেষে আগামী রোববার তা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। অনুমোদন পেলে জুনের মধ্যেই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.