রদ্রিগো লাসমার- ভদ্রলোকের খুব ব্যস্ত সময় কাটছে দোহাতে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বুলেটিনের মতো রিপোর্ট পাঠাতে হচ্ছে রিও ডি জেনেরিওর ব্রাজিল ফুটবল সংস্থার প্রধান দপ্তরে। নেইমারদের দলের সঙ্গে থাকা এই চিকিৎসককে কাতারে আসা স্বদেশি সাংবাদিকদের ফোনও ধরতে হচ্ছে মাঝেমধ্যে। প্রত্যেককেই একই উত্তর- ‘সব ঠিক আছে, সুস্থ হয়ে যাবেন নেইমার।’ গোড়ালির লিগামেন্টে চোট পাওয়া নেইমার ঠিক কবে নাগাদ ফিট হয়ে মাঠে নামতে পারবেন- তার উত্তর দেননি কিংবা দিতে চাননি লাসমার। শুধু বলেছেন, সোমবার সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে হয়তো নেইমার খেলতে পারবেন না। নেইমার ছাড়াও সেদিন রাইটব্যাক দানিলোরও বাঁ পায়ের গোড়ালিতে চোট লেগেছে। তাহলে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রুপ পর্বের বাকি দুটি ম্যাচ সুইজারল্যান্ড আর ক্যামেরুনের বিপক্ষে নেইমার আর দানিলোর শূন্যস্থানে কোন দুটি নাম বসাবেন কোচ তিতে? হাতে থাকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রই হতে পারেন তিতের সেরা অপশন।
রিয়াল মাদ্রিদের এই উইঙ্গার ড্রিবলিং আর বল কেরিয়ারে নেইমারের কাছাকাছি। তবে তিনি ক্লাব ফুটবলে লেফট উইংয়েই বেশি খেলে থাকেন। দ্বিতীয় অপশন অবশ্যই রদ্রিগো। রিয়াল মাদ্রিদের এই ফরোয়ার্ড যে কোনো পজিশন থেকে খুব সহজেই অ্যাটাকে যেতে পারেন। তৃতীয় অপশন গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেল। আর্সেনালের এই ফরোয়ার্ডের মধ্যে নেইমারের অনেক ছাপ রয়েছে। এ ছাড়া রাফিনহা, অ্যান্থনি, জেসুস, ফ্রেড রয়েছেন তিতের হাতে।
আসলে বিশ্বকাপ যে নেইমারের জন্য কাঁটা ঝোপ, সেটি তো তাঁর ভাগ্যলিপিতেই লেখা। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা তাঁকে ঘিরে ধরবেন, তিনি বল মাথার ওপর দিয়ে ট্রিক করে নিতে চাইবেন এবং তারপর বিশ্রী ট্যাকলে পড়ে গিয়ে যা তা অবস্থা! গেল দুই বিশ্বকাপ থেকেই তো একই চিত্রনাট্য, তাই এবার এসব ভেবেই স্কোয়াড তৈরি করে নিয়ে এসেছেন তিতে। তার পরও সেলেকাওদের মধ্যে নেইমার হলেন অক্সিজেনের মতো। ড্রেসিংরুমে তাঁর হাসিঠাট্টা, অনুশীলনে তাঁর খুনসুটি, মাঠে গোল করার পর তাঁর ড্যান্স- এসবই প্রেরণা দেয় গোটা দলকে। সেই হাসিমুখটাই যখন হাসপাতালের রুমে, তখন কাল বিকেলে অনুশীলন পর্বই বাদ দিয়েছে ব্রাজিল। ফিফার সূচিতে বিকেল ৫টায় আল অ্যারাবিয়া স্টেডিয়ামে সেলেকাওদের অনুশীলন পর্ব থাকলেও সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে। মিডিয়াকেও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে গেট থেকে, প্রত্যাখ্যাত ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকরা অনেকটা মুখ গোমরা করে মিডিয়া সেন্টারে ফিরে আলোচনায় ২০১৪ আর ২০১৮। সবার ভয়, নেইমারকে দিয়ে দলের মধ্যে এই অতি আবেগ আবার যেন দলকে না ভোগায়। সেবার নিজেদের দেশে কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়া ম্যাচে পিঠে চোট পেয়ে ছিটকে যান নেইমার। সেমিতে তাঁর ১০ নম্বর জার্সি নিয়ে থিয়াগো সিলভাদের কান্না। পরে জার্মানির সঙ্গে ম্যাচের ফল তো সবারই জানা- ৭-১। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেও নেইমারের পড়ে যাওয়ার ছবিটিই সবার সামনে ভেসে আসে আগে। ডান পায়ের গোড়ালির চোট পরের বছর কোপা থেকেও নেইমারকে দূরে রেখেছে। ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকরাই বলাবলি করছিলেন, গত বছর বাঁ পায়ের গোড়ালির চোট সারতে নেইমারের সময় লেগেছিল ১০ সপ্তাহ। পিএসজির হয়ে খেলতে পারেননি তিনি তিন মাস। তাহলে এবারও কি তেমনই চোটে পড়েছেন নেইমার? তাহলে তো গ্রুপ পর্বই শুধু নয়, বিশ্বকাপের বাকিটাও আর খেলা হবে না তাঁর।
নেইমারের ছিটকে যাওয়ার খবর মানেই প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে এগিয়ে রাখা এবং ব্রাজিল দলেরও মানসিকভাবে ভেঙে পড়া। হয়তো সেই কৌশলগত কারণেই নেইমারের চোটের আসল অবস্থা লুকিয়ে রাখতে চাইছেন তিতে। গোড়ালির ছোটখাটো চোট থাকলে ১০ দিনের মধ্যে ফিট হয়ে মাঠে নামা যায়, এর বেশি হলে অন্তত তিন মাস। আগের দিন নেইমার তাঁর ইনস্টাগ্রামে যে আবেগঘন বার্তা লিখেছেন, সেখানেও কিন্তু মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়ার সুর। ‘কখনও কারও খারাপ চাইনি, প্রয়োজনে কাউকে সাহায্য করেছি। কিন্তু আজ আমার এই অবস্থা। আমি চোটে পড়েছি, ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। তবে আমার বিশ্বাস রয়েছে যে আবার আমি মাঠে ফিরব। এই জার্সিটা আমার গর্ব, আমি ভালোবাসি এই জার্সি পরতে। ঈশ্বর যদি আমাকে কখনও বলে আমি কোথায় জন্মগ্রহণ করতে চাই, আমি বলব অবশ্যই ব্রাজিল।’ নেইমারের এই পোস্ট নিয়ে নাকি ব্রাজিলের ফেসবুক দেয়ালে কেউ কেউ ট্রল করছে। সেখানকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেইমার এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিশ্বকাপ খেলা ‘নাজমুল হোসেন শান্ত’! কাতারে আসা সাও পাওলোর এক টেলিভিশন সাংবাদিক তাঁর ফেসবুক থেকে নেইমারকে নিয়ে কিছু মিম এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাঙ্গাত্মক কিছু পোস্ট দেখাচ্ছিলেন, যা চোখ এড়ায়নি ব্রাজিলের ড্রেসিংরুমেরও। নিজ দেশের সমর্থকদের উদ্দেশেই তাই পাল্টা একটি পোস্ট দিয়েছেন রাফিনহা। তিনি লিখেছেন, ‘আর্জেন্টিনার সমর্থকরা মেসিকে ঈশ্বরের মতো মনে করে। পর্তুগালের ভক্তরা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে রাজা মনে করে। আর ব্রাজিলের সমর্থকরা প্রত্যাশা করে যেন নেইমারের পা ভেঙে যায়। নেইমারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুল, সে ব্রাজিলে জন্মেছে। এই দেশ তাঁর প্রতিভার মূল্য দিতে পারেনি।’
রাফিনহার এই পোস্ট নিয়ে সাও পাওলো থেকে রিও ডি জেনেরিও- সবখানেই নাকি চাপা আগুন ছড়াচ্ছে ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে। দোহা থেকেও যার আঁচ পাচ্ছেন বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকরা। যদিও তাঁদের প্রত্যেকেরই বিশ্বাস, এবার অন্তত নেইমারের চোট গোটা দলকে আঘাত করবে না। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করার মতো তরুণরা এসে গেছে দলে।