সম্প্রতি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কীভাবে হবে, সেটা দেশটির আইনেই আছে। তিনি বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের রাজনীতিবিদদের প্রয়াসকে নব্য উপনিবেশবাদ বলে আখ্যায়িত করেন (প্রথম আলো, ৮ জুলাই ২০২৩)। নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশে পর্যাপ্ত আইন আছে। কিন্তু এগুলোর প্রয়োগ কি হচ্ছে? আর আইনগুলোই কি সঠিক ও জনকল্যাণে প্রণীত?
নির্বাচনী আইনের বিষয়েই আসা যাক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী আইন হলো ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২’ (আরপিও)। এই আইন ২০০৭ সালে ব্যাপকভাবে সংস্কার করা হয়, যেখানে আমাদের প্রতিষ্ঠান ‘সুজন’-এর ভূমিকা ছিল। কিন্তু আইনটিকে দুর্বল করার জন্য অতীতে উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হলেও বর্তমান কমিশন তাতে সফল হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করেছে, যা নিয়ে আবার জাতিকে বিভ্রান্ত করারও চেষ্টা করছে।
‘পরাধীন’ ইসিকে আরও পরাধীন করা হলো!
এ ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো আইনটির প্রয়োগ নিয়ে। আরপিওর ৯০ ধারা অনুযায়ী নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থাকা অবৈধ। কিন্তু লেজুড়বৃত্তির ছাত্রসংগঠনগুলোর অনাচার এবং শিক্ষক সংগঠনগুলোর পাঠদান ও গবেষণার পরিবর্তে নগ্ন দলবাজি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চর দখলের আখড়ায় পরিণত করেছে। প্রসঙ্গত, বিদ্যমান তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি দণ্ডবিধির ১৫৩ খ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ক্ষেত্রেও আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।
আরপিওর যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার কারণ হলো পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ। একটি অভাবনীয় কৌশল অবলম্বন করে গত নূরুল হুদা কমিশনে দলীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে ক্ষমতাসীন দলের অংশীদার তরীকত ফেডারেশনের তাদের সুপারিশ করা প্যানেল থেকে তিনজন নিয়োগ পেয়েছে বলে দাবি করেছে। একই কৌশল বর্তমান আউয়াল কমিশনে নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে এবার ছোট দলগুলোই ‘কিংমেকার’ হয়েছিল (প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০২২)।
নির্বাচনসংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো ‘ভোটার তালিকা অধ্যাদেশ, ২০০৭’। এই আইনের অধীন সেনাবাহিনীর সহায়তায় ২০০৭ সালে যে ছবিযুক্ত তালিকা তৈরি করা হয়, তা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নির্ভুল ভোটার তালিকা। ওই তালিকায় পুরুষের তুলনায় ১৪ লাখের বেশি নারী ভোটার ছিলেন। পক্ষান্তরে সর্বশেষ ভোটার তালিকায় নারীদের তুলনায় পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ১৭ লাখের বেশি। ভোটার তালিকায় এমন ‘জেন্ডার গ্যাপ’ নিঃসন্দেহে অবাধ নির্বাচনের পথে অন্তরায়।
নির্বাচনসংক্রান্ত সবচেয়ে বড় আইন আমাদের সংবিধান। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার কথা। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোনো ‘নির্বাচন’ই হয়নি, কারণ, নির্বাচন হলো বিকল্পের মধ্য থেকে বেছে নেওয়া এবং এসব আসনে কোনো বিকল্প প্রার্থীই ছিলেন না।
আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগসাজশে। অভিযোগ আছে নির্বাচনে কারসাজির কাজ হয়েছে রাতে, সে কারণে এই নির্বাচন পরিচিতি পেয়েছে রাতের ভোট হিসেবে।
এর প্রমাণ হিসেবে নির্বাচনের দিন ভোরে ব্যালটভর্তি বাক্সের ছবি বিবিসি প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া টিআইবি ৫০ নির্বাচনী এলাকায় পরিচালিত গবেষণার ভিত্তিতে আগের রাতে ব্যালট বাক্সভর্তি ও নির্বাচনের দিনে নানা অনিয়মের তথ্য প্রকাশ করেছে। নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ‘সুজন’ দেখায় যে গত নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে বিএনপি শূন্য ভোট পেয়েছে, জাতীয় পার্টি ৩ হাজার ৩৮৮ কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছে, আওয়ামী লীগও দুটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছে এবং ৬৬৭টি কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক সব ভোট পেয়েছে। এসব অবিশ্বাস্য ফলাফল মধ্যরাতে ব্যালট বাক্স ভর্তিরই ফসল।
দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের এমন বিজয়ের মূল কারণ হলো ৩০ জুন ২০১১ তারিখে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, যে সংশোধনী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে সৃষ্ট ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্তে’র অবসান ঘটিয়ে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করেছে। যার ফলে যিনি দলীয় প্রধান, তিনিই হবেন নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান এবং তাঁর মন্ত্রিসভার অধীনই থাকবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দলীয়করণের কারণে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন হয়ে উঠেছে নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মূল নিয়ামক শক্তি। পঞ্চদশ সংশোধনী একদিকে যেমন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করেছে, অন্যদিকে সুনিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পথ।
সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ রুদ্ধকারী পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংবিধান ‘উইল অব দ্য পিপল’ বা ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ হলেও, পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত ছিল সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। বিরোধী দলের এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই ছিল না। এ ব্যাপারে সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে কোনো উল্লেখযোগ্য বিতর্কও হয়নি। তাই পঞ্চদশ সংশোধনীর লেজিটিমেসি প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
পঞ্চদশ সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ৮ সংশোধন করা হয়, যেগুলো সংশোধনের ক্ষেত্রে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সুবাদে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক ছিল। তাই গণভোটের আয়োজন না করে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসকে সংবিধানের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, আপিল বিভাগের ১০ মে ২০১১ তারিখের সংক্ষিপ্ত আদেশে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ‘প্রসপেকটেভলি’ বা ভবিষ্যতের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আদালতের এ আদেশ বিবেচনায় না নিয়ে, আদালত এটি বাতিল করেছে—এমন একটি প্রচারণার মাধ্যমে, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় ১৫ মাস আগেই, সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে, যা নিঃসন্দেহে সংবিধানের লঙ্ঘন। গবেষক ড. আদিবা আজিজ খানের মতে, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং ভোটারদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সংসদে তার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী দুই জাতীয় নির্বাচনের সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকার আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে।
নির্বাচন কমিশন : ক্ষমতা খর্ব নয়, ক্ষমতার প্রয়োগ চাই
তৃতীয়ত, সংসদে পাস করা প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ১৫ সদস্য নিয়ে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির বিশেষজ্ঞ ও সমাজের সব ক্ষেত্রের ১০৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময়ের ভিত্তিতে প্রণীত তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সংবিধান সংশোধনের ২৯ মে ২০১১ তারিখের সর্বসম্মত সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী একক সিদ্ধান্তে বাতিল করে দেন। এটি ছিল ‘সেপারেশন অব পাওয়ার্স’ বা ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
চতুর্থত, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের ‘মৌলিক বিধানাবলি’ আখ্যায়িত করে সংশোধন অযোগ্য করাও ছিল সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক। কারণ, ‘মৌলিক কাঠামো’ ছাড়া সংবিধানের অন্য সব অনুচ্ছেদ সংশোধন করা সংসদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।
আরও কয়েকটি আইন আছে, যেমন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’, যেগুলো নিবর্তনমূলক ও ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে প্রণোদিত। এসব আইনের ব্যবহার করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ এবং কণ্ঠ রোধ করা হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পুলিশের অনুমতির প্রয়োজন হয়, যদিও এগুলো আমাদের মৌলিক অধিকার। এ ছাড়া আরও আইন আছে, যার কারণে ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, কয়েক বছর আগে এমন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ভারতের খরচ হয়েছিল মাত্র ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
পরিশেষে, বাংলাদেশের ইতিহাসে যে ১১টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার ৭টি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীন চরম বিতর্কিত নির্বাচন। বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে ভবিষ্যতের নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই কি আমাদের বন্ধুরা চান?
● ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন