বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বহুল প্রতীক্ষিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর এক বার্তায় এ তথ্য জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বন্ধুপ্রতিম দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় যোগাযোগ, বাণিজ্যিক সংযুক্তিসহ অন্যান্য বিষয় স্থান পেয়েছে। এদিকে, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এই আলোচনার ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামীর রাজনীতি। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পরই রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেটিও ফলপ্রসূ হয়েছে বলে এক বার্তায় জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকেলে নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন লোককল্যাণ মার্গে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠক হয়। এরপর এক্সে (টুইটারে) এক বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক। আমাদের আলোচনায় কানেকটিভিটি, বাণিজ্যিক সংযুক্তি এবং আরও অনেক বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া তিন সমঝোতা স্মারক হলো– কৃষি গবেষণায় সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে আর্থিক লেনদেন সহজীকরণ।
এদিকে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে কথা হয়নি। তবে তাদের একান্ত বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কিনা জানি না। গতকাল রাতে দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকের পর দিল্লির একটি হোটেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-ভারত বিদ্যমান গভীর সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে একমত হয়েছেন। উভয় দেশের মধ্যকার অনিষ্পন্ন সমস্যা সমাধানে আলোচনার তাগিদ দেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী উভয় দেশের মধ্যকার অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো অফিসিয়াল পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারত আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে কানেকটিভিটি তথা রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা এবং কার্যক্রম বেগবান করতে উভয় প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন।
ড. মোমেন বলেন, উভয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ এবং ভারতের বিদ্যমান গভীর সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একমত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, গত বছরের ৪-৮ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে তাঁর সফল রাষ্ট্রীয় সফরের পর দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানাবিধ ক্ষেত্রে প্রভূত দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। এই জন্য উভয় প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্যের কথা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিতকরণে অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শনিবার দুই দিনব্যাপী জি২০ শীর্ষ সম্মেলন নয়াদিল্লিতে শুরু হচ্ছে। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গতকাল অনুষ্ঠেয় জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইট শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে নয়াদিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে পৌঁছার পর ভারতের রেলওয়ে ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী দর্শনা জার্দোস প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সফরসঙ্গী অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানাও রয়েছেন। এর আগে সকাল ১১টায় ফ্লাইটটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়।
শনিবার শুরু হওয়া জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে বর্তমান সরকারের মেয়াদে বিভিন্ন আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যের অভিজ্ঞতা অংশগ্রহণকারী বিশ্ব নেতাদের কাছে তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’। একই দিন প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনের সাইডলাইনে একাধিক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এর মধ্যে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপ্রধান, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
রোববার জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের দ্বিতীয় এবং শেষ দিনে প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য দেশের নেতার সঙ্গে রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে যোগ দেবেন তিনি। সম্মেলনের শেষ দিনে ‘জি২০ নয়াদিল্লি নেতাদের ঘোষণা’ গৃহীত হবে। ওইদিনই প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়েছিল। দেশটির মেয়াদকালীন বাংলাদেশসহ সদস্য নয় এমন ৯টি দেশকে জি২০ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানায় ভারত। দেশগুলো হলো– বাংলাদেশ, মিসর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
জি২০ এর ১৯টি দেশ আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। জি২০ সদস্যরা বিশ্বব্যাপী জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ, বিশ্ব বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশের বেশি এবং বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব করে।