নির্বাচনের বছরে খুশি করার প্রকল্প

0
183
বাজেট ২০২৩–২৪

উচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভবন, সড়ক, সেতু নির্মাণের মতো প্রকল্প।

ডিসেম্বরের আগে সাতটি বড় প্রকল্প উদ্বোধন।

১০ প্রকল্পে এডিপির ২৩% বরাদ্দ।

নির্বাচনের বছর উন্নয়ন প্রকল্পের দিকে সবার আগ্রহ থাকে। সরকারও জনতুষ্টির জন্য নানা ধরনের প্রকল্প পাস ও বাস্তবায়ন করে। আবার কিছু প্রকল্প নির্বাচনের আগে শেষ করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এরই মধ্যে পাস হয়েছে। সেখানে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন অগ্রাধিকার হিসেবে বরাদ্দহীন ৮২৫টি নতুন প্রকল্প রাখা হয়েছে। এসব প্রকল্প বছরজুড়ে পাস করা হবে। সেখানে উচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভবন, সড়ক, সেতু নির্মাণের মতো প্রকল্পের ছড়াছড়ি। আবার গরু-ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রকল্পও রাখা হয়েছে। আছে বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জনতুষ্টির প্রকল্পও।

আগামী ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার এডিপি পাস হয়েছে। এডিপিতে ১ হাজার ৩০৯টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথসহ অন্তত সাতটি বড় প্রকল্প শেষ করতে এডিপিতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দও রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন, যোগাযোগ—এসবকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব অগ্রাধিকার বিবেচনায় প্রকল্প পাস করা হবে। তবে জরুরি প্রয়োজন না হলে ভবন নির্মাণের প্রকল্প আপাতত পাস করা হবে না। আমরা এখন প্রকল্প শেষ করার দিকে বেশি জোর দিচ্ছি। এ বছরই বেশ কয়েকটি প্রকল্প শেষ হবে, জনগণও তার সুফল পাবে।’ নির্বাচন সামনে রেখে প্রকল্প পাস হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নয়; জনবান্ধব প্রকল্পই পাস করতে চাই। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো হচ্ছে।’

এবার এডিপিতে ৮২৫টি অননুমোদিত প্রকল্পের যে তালিকা রয়েছে তাতে অর্ধেকের বেশি প্রকল্পকে উচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে দেখানো হয়েছে।
কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ছড়াছড়ি

এডিপি পাস করার সময় বরাদ্দহীন অননুমোদিত হিসেবে নতুন প্রকল্পের একটি তালিকা দেওয়া হয়। এই তালিকা ধরে বছরজুড়ে প্রকল্প পাস করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এবার ৮২৫টি অননুমোদিত  প্রকল্পের তালিকার অর্ধেকের বেশি প্রকল্পকে উচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে দেখানো হয়েছে। ডলার–সংকট, কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ার বাস্তবতার মধ্যে এই তালিকায় জনতুষ্টি এবং কম অগ্রাধিকারের বহু প্রকল্প ঢুকে গেছে। যেমন ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে কর্মসংস্থান ব্যাংকের ভবন নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ২৬০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প এখন এডিপির সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় আছে।

ফেনী-ছাগলনাইয়া-করের হাট সড়কে শুভপুর সেতু নির্মাণে ৫০০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত প্রকল্প রয়েছে। আবার চাঁদপুরের মতলব উত্তর-গজারিয়া সড়কে মেঘনা-ধনাগোদা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণে রাখা হয়েছে আরও ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প।

উলিপুর-চিলমারী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে ৬৮ কোটি টাকার প্রকল্পও অগ্রাধিকারের তালিকায় আছে। সাধারণত সড়ক ও সেতু নির্মাণের প্রকল্পগুলো নির্বাচনের আগে পাস করে স্থানীয় জনগণকে তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়।

চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের এডিপি কাটছাঁটের অন্যতম কারণ হলো কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়া। কিন্তু গরু-ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আগামী অর্থবছরে উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পাস করতে ৬৫০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪২৪ কোটি টাকা খরচ করে প্রুভেন ষাঁড়ের উৎপাদন বাড়ানো হবে। আবার বেঙ্গল জাতের ছাগলের উৎপাদন বাড়াতে ২২৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

নতুন প্রকল্পে বিনোদনকেন্দ্র বাদ যাবে? রাজধানী ঢাকা ও রংপুরের চিড়িয়াখানার উন্নয়নে ১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকার প্রকল্পও আছে সরকারের উচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায়। এ রকম পাঁচ শর মতো প্রকল্প উচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই রাস্তাঘাট, ভবন, সেতুসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনীতিতে একধরনের চাপ আছে। রাজস্ব আদায়ের প্রবণতা অন্য সময়ের তুলনায় কম। এমন অবস্থায় নির্বাচনের বছর হলেও প্রকল্প পাস করা উচিত যথেষ্ট যাচাই–বাছাই করে। নির্বাচনের সময় রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণের প্রকল্প পাসের চাপ থাকে। স্থানীয় নেতারা জনগণের সামনে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে চান। শুধু জনতুষ্টির জন্য এমন প্রকল্প পাস করা হয়। তিনি মনে করেন, ভোট লক্ষ্য করেই মূলত এসব প্রকল্প শেষ করা বা দৃশ্যমান করতে চায় সরকার।

অর্থনীতিতে একধরনের চাপ আছে। রাজস্ব আদায়ের প্রবণতা অন্য সময়ের তুলনায় কম। অর্থের টানাটানি আছে। এমন অবস্থায় নির্বাচনের বছর হলেও প্রকল্প পাস করা উচিত যথেষ্ট যাচাই–বাছাই করে। নির্বাচনের সময় রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণের প্রকল্প পাসের চাপ থাকে। স্থানীয় নেতারা জনগণের সামনে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে চান।

সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

সাতটি বড় প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে

নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে। এ জন্য এডিপিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দওরাখা হয়েছে।

রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের অপেক্ষা শেষে আগামী অক্টোবর মাসে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হবে। ইতিমধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়ে গেছে। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জুলাই থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে রেল চলাচল শুরু হবে।

ঢাকার আরেক বড় প্রকল্প হলো, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প। এটি নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী অক্টোবরে এই টার্মিনালের আংশিক খুলে দেওয়া হবে।

একই সঙ্গে বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর ওপর দিয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ খুলে দেওয়া হবে। বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত আগামী অক্টোবরে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কবাতি লেগে গেছে। এখন পিচঢালাই চলছে। উড়ালসড়ক থেকে নামার র‍্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে।

এদিকে চারটি বড় রেল প্রকল্পও নির্বাচনের আগে শেষ হবে। এর মধ্যে অক্টোবরের আগেই দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হবে। ফলে নির্বাচনের আগেই রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের উদ্বোধনের পরিকল্পনা চলছে। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৮৫ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়ে গেছে এ প্রকল্পের।

খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই রেলপথ খুলে দেওয়া হতে পারে।

এ ছাড়া ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত প্রায় ৭২ কিলোমিটার ডাবল রেলপথের কাজও প্রায় শেষ দিকে। নির্বাচনের আগেই এই অংশের কাজ শেষ করতে চায় সরকার। এই অংশ চালু হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পুরো পথই ডাবল লাইন হয়ে যাবে।

নির্বাচনের আগে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু–ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে চায় সরকার। এই প্রকল্পের অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাওয়া পর্যন্ত পরীক্ষামূলক ট্রেনও চলাচল করেছে।

এ ছাড়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পুরোদমে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। এখন ৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এ কেন্দ্রে।

১০ প্রকল্পেই বরাদ্দ এডিপির ২৩%

নির্বাচনের বছরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দেশের বৃহৎ প্রকল্পগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বড় ১০ প্রকল্পেই মোট এডিপির ২৩ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই ১০ প্রকল্পে সব মিলিয়ে ৬০ হাজার ৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের জন্য আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ৯ হাজার ৮১ কোটি টাকা এবং চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪) ৮ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।

এ ছাড়া বেশি বরাদ্দ পাওয়া শীর্ষ ১০ প্রকল্পের তালিকায় আরও আছে ঢাকা–আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ, ফিজিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট (পিএফডি); এমআরটি-১ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ এবং এমআরটি-৬।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.