বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল দেশবাসী। এর মধ্যে আমিষ পণ্য ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা সব জায়গায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে কাজ করে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।
নিত্যপণ্যের বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করার কথা বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের। কারণ, এই কমিশনের সৃষ্টি হয়েছে বাজারে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, জোটবদ্ধভাবে দ্রব্যমূল্যের মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের লক্ষ্যে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কমিশন একটি বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। এ কমিশনে নেই আইন বিশেষজ্ঞ, নেই অর্থনীতিবিদ। বিশেষজ্ঞ জনবলের অভাবে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না এই কমিশন। আবার অনেক ক্ষেত্রেই এই কমিশনের বিরুদ্ধে বেআইনি কাজ ও ব্যবসায়ীদের অযথা হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
এ কারণে ডিম, মুরগি, পেঁয়াজ, আলুসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে প্রতিযোগিতা কমিশনের সংস্কার চান সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগে প্রতিযোগিতা কমিশনের আইনি কাঠামোর সংস্কার দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে অনেক সমস্যা লাঘব হতে পারত। বাজারে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হয়ত নিয়ন্ত্রণ করা যেত। প্রশ্ন হলো, ডিম ও মুরগির দাম কমাতে আইন মেনে কতটুকু যথার্থভাবে কাজ করছে প্রতিযোগিতা কমিশন?
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে হঠাৎ ২০২২ সালের আগস্ট মাসে মুরগি ও ডিমের বৃদ্ধি পায়। বলা হলো— সিন্ডিকেট এই মূল্য বৃদ্ধির কারণ। পরে প্রতিযোগিতা কমিশন বাজার নিয়ন্ত্রণে তড়িঘড়ি করে স্বপ্রণোদিত মামলা দিলো বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় পোলট্রি খামার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করার বিধি প্রণয়ন না করেই কমিশনে শুরু হয় মামলার কার্যক্রম। পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি পোলট্রি খামার প্রতিষ্ঠানকে চাপিয়ে দিল মোট অঙ্কের আর্থিক জরিমানা। জরিমানাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো উপায়ান্তর না পেয়ে দারস্থ হলো সুপ্রিম কোর্টের। প্রতিযোগিতা কমিশনের আদেশে প্রায়োগিক ও পদ্ধতিগত ভুল পরিলক্ষিত হলে আদেশগুলোর বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট।
সম্প্রতি বন্যা, বৃষ্টি ও গরম আবহাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজারো প্রান্তিক খামার। বাজারে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যায়। এ অবস্থায় প্রতিযোগিতা কমিশন সমস্যার মূল কারণ চিহ্নিত না করে পোলট্রি খামারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত মামলা করে। খামারিদের ডেকে নিয়ে একটি সভাও করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন, দুই সদস্য ও অন্যান্য কর্মকর্তা এবং কমিশনের দেওয়া মামলায় অভিযুক্ত পোলট্রি খামারি প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।
সেদিন সভায় কমিশনের সদস্য হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা সিন্ডিকেট ভাঙবই। আপনাদের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। যদি সহযোগিতা না করেন তাহলে প্রতিযোগিতা কমিশনের ক্ষমতা আছে আপনাদের বড় অঙ্কের শাস্তি দেওয়ার।
এ সময় বাংলাদেশ ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান কমিশনের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, মামলা দিয়ে আপনারা পোলট্রি কোম্পানিগুলোকে এতো হ্যারাসমেন্ট করেছেন যে বিনিয়োগের পরিবেশ এখন নেই। মামলাগুলো আপনাদের প্রত্যাহার করা উচিত।
বাংলাদেশ ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি কাজী জাহিন হাসান বলেন, ডিমের বাজারে প্রতিদিন কয়েক হাজার উৎপাদনকারী ও পাইকারি বিক্রেতারা বেচাকেনা করে। এতো সংখ্যক লোক যখন একটা বাজারে বেচাকেনা করে সেই বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারে না। ডিমের বাজার একটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করতে পারে না। বড় খামারিগুলো মোট ডিমের চাহিদার ২০ শতাংশ উৎপাদন করে আর বাকি ৮০ শতাংশ উৎপাদন করে প্রান্তিক ছোট খামারিগুলো। বন্যা, গরম ও অতিবৃষ্টির কারণে অনেক প্রান্তিক খামার ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এতে করে ডিমের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। চাহিদার তুলনায় বাজারে ডিমের জোগান কম। তা ছাড়া, মুরগি খাদ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় বাজারে ডিমের যোগান কম। এ ছাড়া মুরগির খাদ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনারা দয়া করে কমিশনে একজন অর্থনীতিবিদ নিয়োগ দিয়ে বাজার বিশ্লেষণ করেন। তাহলে কোথায় সমস্যা আপনারা বুঝতে পারবেন।
প্রতিযোগিতা কমিশনের দুর্বলতা নিয়ে জানতে চাইলে কমিশনের সাবেক পরিচালক খালিদ এ নাসের বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাজার অ্যানালাইসিস করা। কেন নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি হলো, এর পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে, সেটা খুঁজে বের করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য প্রতিযোগিতা কমিশনে বাজার গবেষণা করার জন্য একজন অর্থনীতিবিদও নেই। আবার এই কমিশনে একজন আইন বিশেষজ্ঞ নেই। আমি মনে করি প্রতিযোগিতা কমিশনকে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হলে এখানে অর্থনীতিবিদ প্রয়োজন। আইনি কাঠামো স্বচ্ছ করা প্রয়োজন।
আইনি কাঠামোর সংস্কার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজিয়া কবির বলেন, সত্যিকার অর্থে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিযোগিতা কমিশন আইন ২০১২ এর ৩৭ (২) ধারা অবিলম্বে বাতিলপূর্বক প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ সংস্কার করা জরুরি। তা না হলে কমিশন ও সরকারের ওপর জনগণের এবং অংশীজনদের আস্থার সংকট বাড়বে।
এদিকে প্রতিযোগিতা কমিশনের একাধিক আদেশ হাইকোর্ট স্থগিত করেছেন। তা ছাড়া, কমিশনের আর্থিক বিষয় নিয়ে করা হয়েছে জনস্বার্থে মামলা, যেগুলো এখনো বিচারাধীন। কমিশনের নিজের কাছেও রয়েছে বিচারাধীন কয়েক ডজন মামলা। এ অবস্থায় প্রতিযোগিতা কমিশন বা তার কোনো সদস্যের যাকে তাকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা কতটুকু আইনসম্মত সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রতিযোগিতা আইনবিদ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ।
তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী কমিশন গঠন করতে হবে। এর মধ্যে থাকবেন অর্থনীতি, আইন ও বাজার বিষয়ে সর্বনিম্ন ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে কখনোই অর্থনীতি, আইন বা বাজার বিষয়ে এমন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোনো ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন গঠিত হয়নি। যার ফলে প্রতিযোগিতা কমিশন তার করণীয় কার্যক্রম ভুলভাবে সম্পাদন করেছে পাশাপাশি আইন ভঙ্গ করেছে। কমিশনের অনেক কার্যক্রমও যে বেআইনি তা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আইনসম্মতভাবে কমিশন গঠন না করা, মামলা কীভাবে পরিচালনা হবে সে বিষয়ে কোনো বিধি না করেই মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ না করে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে বিবাদীকে জরিমানা আরোপ করে আদেশ প্রদান করা; এগুলো সবই বেআইনি যা কমিশন একের পর এক করে গেছে এবং এখনো করছে। সঙ্গত কারণেই হাইকোর্ট কমিশনের বেশ কয়েকটি আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।
হামিদুল মিসবাহ বলেন, আমি মনে করি দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিযোগিতা কমিশনকে আইনে উল্লিখিত পন্থায় পুনর্গঠন করতে হবে এবং কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে বা শাস্তি দিতে হলে তা আইন মেনে করতে হবে। মামলার কার্যক্রম ভুলভাবে পরিচালনা করা বন্ধ করতে হবে, যা এখনও কমিশন করে আসছে। আর তা না হলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে, যাতে করে বাজারে পণ্যের যোগানে ঘাটতি দেখা দিবে ও বাড়তে থাকবে পণ্যের মূল্য। এককথায় অস্থিতিশীল হবে বাজার। আর এর খেসারত দিতে হবে দেশের জনগণ ও অর্থনীতিকে।
তিনি বলেন, প্রতিযোগিতা কমিশনকে সংস্কার করে নতুন রূপে গঠন ও আইনসম্মতভাবে কার্যাবলী সম্পাদন নিশ্চিতকরণে জাতীয় স্বার্থে হাইকোর্ট বিশেষ দিকনির্দেশনামূলক আদেশ প্রদান করতে পারেন। প্রয়োজনে আমরা বিষয়টি হাইকোর্টের দৃষ্টিতে আনব।