নারী ফুটবলারের খেলার ছবি দেখিয়ে পরিবারকে লাঞ্ছিত, প্রতিবাদ করায় মারধর

0
206
হামলায় আহত নারী ফুটবল খেলোয়াড় মঙ্গলী বাগচীকে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি

খুলনার বটিয়াঘাটায় বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ফুটবলার সাদিয়া নাসরিনের (১৭) খেলার ছবি তুলে পরিবারকে দেখিয়ে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেটার প্রতিবাদ করায় গত শনিবার তাঁকে ও তাঁর সতীর্থদের মারধর করা হয়েছে। এ ঘটনায় সাদিয়া বটিয়াঘাটা থানায় মামলা করলে গতকাল রোববার একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সাদিয়া, তাঁর পরিবার ও সতীর্থদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাদিয়ার পরিবার চাইত না, সাদিয়া ফুটবল খেলুক। পরিবারের চোখ এড়িয়ে নিজ গ্রাম বটিয়াঘাটার তেঁতুলতলার এক ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন করতেন সাদিয়া। এ নিয়ে স্থানীয় অনেকের কাছে তাঁকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়।

সর্বশেষ নূপুর খাতুন নামের একজন তাঁর খেলার ছবি তুলে পরিবারকে দেখিয়ে আপত্তিকর নানা কথা বলেন। এর প্রতিবাদ করায় সাদিয়া, তাঁর তিন ফুটবলার সতীর্থ মঙ্গলী বাগচী (১৯), হাজেরা খাতুন (১৯) ও জুঁই মণ্ডল (১৭) হামলার শিকার হন। হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাদিয়া মামলা করেছেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, সাদিয়া স্থানীয় ‘সুপার কুইন ফুটবল একাডেমিতে’ নিয়মিত অনুশীলন করেন। গত বৃহস্পতিবার একাডেমিতে অনুশীলনের সময় নূপুর খাতুন নামের একজন তাঁর ছবি তোলেন। সেই ছবি সাদিয়ার মা–বাবাকে দেখিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করেন। এ নিয়ে মা–বাবা তাঁকে বকাঝকা করেন। ছবি তুলে মা–বাবাকে দেখানোর কারণ শনিবার বিকেলে জানতে চান সাদিয়া। বিষয়টি নিয়ে তাঁদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়।

একপর্যায়ে সাদিয়াকে গালিগালাজ করেন নূপুর। প্রতিবাদ করলে মারধর করেন। সাদিয়া বিষয়টি তাঁর মা–বাবা, একাডেমির কোচ মুস্তাকুজ্জামান মুস্তাক ও অন্যান্য খেলোয়াড়কে জানান। তাঁরা সাদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে নূপুরের বাড়িতে যান। এতে নূপুরের পরিবারের লোকজন ক্ষুব্ধ হন। পরে নূপুরের ভাই আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, বাবা নুর আলম, মা রঞ্জি বেগম ও আত্মীয় মনোয়ারা তাঁদের ওপর হামলা চালান। এতে সাদিয়া, মঙ্গলী, হাজেরা ও জুঁই আহত হন। হামলার সময় নুর আলমের লোহার রডের বাড়িতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান মঙ্গলী। পরে তাঁদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির একজন প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা দেবাশীষ কুমার মণ্ডল বলেন, গত কয়েক বছর ধরে তেঁতুলতলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে বারবার জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিভাগীয় পর্যায়েও খুব ভালো ফল করছিল। কিন্তু উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুবিধা ঠিকমতো না পাওয়ায় অনেকেই পরে ঝরে যেতে থাকে। এলাকার মেয়েদের ফুটবল নিয়ে ভালো কিছু করার তাগিদে চলতি বছরের শুরুর দিকে তেঁতুলতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একাডেমির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে আর্থিক সংকটে এটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

বটিয়াঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম প্রধান উপদেষ্টা হয়ে এর কার্যক্রম এগিয়ে নেন। যাঁরা আগে এই স্কুল থেকে ফুটবল খেলেছেন, তাঁরা এবং বাইরের মেয়েরাও একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। সাদিয়াসহ এই খেলোয়াড়দের অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। স্থানীয় অনেকেই আছেন, যাঁরা চান না মেয়েরা ফুটবল খেলুক। তাঁদের এই মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সাদিয়া বলেন, ‘নূপুরের পরিবার ঘটনাটি যখন জানতে পারে, তখন যেসব স্থানীয় ব্যক্তি আমাদের খেলার বিরোধিতা করে থাকেন, তাঁদের সঙ্গে জোট করে আমাদের মারেন।’

আহত মঙ্গলী বলেন, ‘প্রচণ্ড মারধরে আমার মাথা ফেটে যায়। আমি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলাম। আমার হাত বাঁধা ছিল। তারা জিজ্ঞাসা করেছিল, কীভাবে আমি ফুটবল খেলার সাহস পাই? এত বড় হয়ে হাফপ্যান্ট পরে কেন খেলি?’ প্রায় দুই ঘণ্টা পর একাডেমির সদস্যরা তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।

বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, মঙ্গলীর মাথায় একটা ক্ষত ছিল, তবে সেটা গভীর নয়। সেলাই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি ভালো আছেন। আরও দুই-তিন দিন পর সেলাই কেটে ছাড়পত্র দেওয়া হবে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

বটিয়াঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শওকত কবির বলেন, ওই ঘটনায় মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে মামলার এক আসামি নুর আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.