বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতিকাণ্ডের পর নতুন করে আলোচনার খাতা খোলেন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) প্রধান নাথান বম। তিনি কোথায় আছেন? ভারতের মিজোরাম, নাকি ইউরোপের কোনো দেশে– তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। তবে এবার নাথানের স্ত্রী লালসমকিম বমেরও মিলছে না খোঁজ। বেশ কিছুদিন ধরে বন্ধ তাঁর মোবাইল নম্বর।
লালসমকিম সরকারি হাসপাতালের সেবিকা (নার্স) হওয়ায় তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। গেল ৮ এপ্রিল রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তাঁকে লালমনিরহাট ২৫০ শয্যা হাসপাতালে তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা হয়েছিল। তবে বদলির ১৪ দিন পার হলেও হদিস নেই নাথানের স্ত্রীর। রুমায় তাঁর বাড়িতে নেই লালসমকিম। গতকাল পর্যন্ত লালমনিরহাটেও যোগ দেননি তিনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লালমনিরহাটে বদলির আদেশের পর থেকেই লাপাত্তা লালসমকিম। রুমা সদরের ২ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাসাতেও তিনি থাকছেন না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে তিনি আত্মগোপনে গেছেন কিনা– এমন আলোচনাও রয়েছে।
বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, লালসমকিমকে না পেয়ে তাঁর তাৎক্ষণিক বদলির অনুলিপি বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। সাধারণত এ ধরনের আদেশের পর জিনিসপত্র গুছিয়ে নতুন বদলির জায়গায় যোগ দিতে ছয় দিন সময় পান। যেদিন লালসমকিমকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে, সেদিন থেকে রুমা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাঁর থাকার সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁকে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে।
লালমনিরহাট ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রমজান আলী বলেন, নাথানের স্ত্রীর বদলির তথ্য আমরা জেনেছি। তবে তিনি এখনও যোগ দেননি। কেন এত দিনেও নতুন কর্মস্থলে আসছেন না, সেটিও মৌখিক বা লিখিতভাবে জানাননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নাথান বমের স্ত্রী ও আরেক নার্স দীপালি বাড়ৈর সঙ্গে কেএনএফের যোগাযোগ আছে– এমন সন্দেহ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কেএনএফের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের তথ্য পাচার হওয়ার শঙ্কা কারও কারও। এর আগেও লালসমকিম বমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তিনি তখন দাবি করেছিলেন, কয়েক বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই।
র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কেএনএফের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। তবে নাথান বমের স্ত্রী কোথায় আছেন, সেটি জানা নেই।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, নাথানের স্ত্রীর হদিস পাচ্ছি না। তিনি বাড়িতে নেই, এটা জেনেছি। নাথানের অবস্থান নিয়েও স্পষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই।
রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেনপাড়ার বাসিন্দা মৃত জাওতন লনচেওর ছেলে নাথান বম। তাঁর বাবা ছিলেন জুমচাষি। মা মৃত রৌকিল বম। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাথান ছোট। অভাব-অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন নাথান। তাঁর দুই ভাই জুম চাষ করেন। নাথানের এক ভাই রোয়াংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। আরেক ভাই অর্থ পাচারের মামলায় রাঙামাটি কারাগারে। ১৯৯৬ সালে নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। ওই বছরই ঢাবির প্রাক্তন উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ বান্দরবান সফরে গিয়ে খিয়াং, লুসাই, ম্রো, বম জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিশ্রুতি দেন। তাই পরীক্ষায় পাস না করলেও নাথান চারুকলা অনুষদে ভর্তির সুযোগ পান।
বান্দরবানে ডাকাতির পর সরকারের উচ্চ পর্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নাথানকে ফেরাতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হবে। এ ব্যাপারে গতকাল পর্যন্ত নোটিশ পাঠানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের ইন্টারপোলের শাখা কার্যালয় ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি আলী হায়দার চৌধুরী সমকালকে বলেন, নাথান বমের ব্যাপারে যে সংস্থা তদন্ত করছে, তাদের কাছ থেকে আবেদন এলেই সেটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় ইন্টারপোলে পাঠানো হবে। আমরা এখনও সে ধরনের চিঠি পাইনি।
এদিকে কেএনএফ তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিবৃতিতে দাবি করে, ‘রাষ্ট্র বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থা কেএনএফের প্রধান নাথান বমকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রী লালসমকিম বমকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করছিল। যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর নাথানের স্ত্রী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পাড়াবাসী তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে পারেনি। লালসমকিম কোথায় আছেন, সে ব্যাপারে কেএনএফের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের কাছে এখনও কোনো তথ্য আসেনি।’
কেএনএফ ২ এপ্রিল রাতে রুমার সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা করে। টাকা নিতে না পেরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে অপহরণ ও পাহারায় থাকা পুলিশ-আনসারের ১৪টি অস্ত্র লুট করে। পরের দিন দুপুরে থানচির সোনালী ও কৃষি ব্যাংক থেকে ১০ লক্ষাধিক টাকা লুট করে তারা। এ ঘটনার পর সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যরা সমন্বিত অভিযান চালান। অভিযানে এখন পর্যন্ত ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমায় কেএনএফ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাউর হয়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক লোক রয়েছে। এ কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত।
কেএনএফের ফেসবুক পেজে তারা জানায়, রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদমসহ ৯ উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ হিসেবে গঠন করা হবে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কে সে সময় ভারতের মিজোরামে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ। সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় বলে ২০২২ সালের অক্টোবরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র্যাব।