বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করার আগে নাইজেরিয়া ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের টাকা ‘আত্মসাৎ’ করেছে বহুস্তর বিপণন বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেড।
দুই দেশের সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, নাইজেরিয়ায় এমটিএফই আত্মসাৎ করেছে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমান। শ্রীলঙ্কায় তারা নিয়েছে ১০০ কোটি রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে এমটিএফই কত টাকা নিয়েছে, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন জেলায় হাজার হাজার মানুষ কোটি কোটি টাকা খোয়ানোর দাবি করছেন।
যেমন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিড়ালাক্ষী মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক আক্তারুজ্জামান বলেছেন, তিনি ঋণ করে প্রায় আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। বিপরীতে মুঠোফোন অ্যাপে কিছু কিছু ‘ডলার’ পেয়েছিলেন। তবে দুই সপ্তাহ আগে থেকে সেই অ্যাপ থেকে আর ‘ডলার’ তুলতে পারছেন না।
নাইজেরিয়া ও শ্রীলঙ্কায় প্রতারণা
নাইজেরিয়ায় এমটিএফইর প্রতারণার খবরটি দিয়েছে সাহারা উইকলি নামের একটি সংবাদমাধ্যম। ১৮ আগস্ট ‘দেশের সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিমটি ১০০ কোটি ডলারের বেশি নিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে’ শিরোনামে প্রকাশিত তাদের খবরে বলা হয়, দেশটির উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ এই বিনিয়োগ করেছিল।
সাহারা উইকলি খবরটি দিয়েছে বাইন্যান্স নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে। আরও দুয়েকটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাইন্যান্সের বরাত দিয়ে খরবটি প্রকাশ করে। উল্লেখ্য, বাইন্যান্স একটি পরিচিত ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে আইন না মানায় যুক্তরাষ্ট্র বাইন্যান্সকে নিষিদ্ধ করে। তবে পরে বাইন্যান্স যুক্তরাষ্ট্র আলাদা কোম্পানি খোলে।
নাইজেরিয়ায় ‘পঞ্জি স্কিমের’ মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনা অতীতে বেশ কয়েকটি ঘটেছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নাইজেরিয়ার দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানায়, নাইজেরিয়ার মানুষ ৫ বছরে ৩০ হাজার কোটি নাইরাস খুইয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার সমান। প্রতারণা নিয়ে দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদন্তের কথাও জানানো হয় ওই খবরে।
শ্রীলঙ্কায়ও এমটিএফই তদন্তের মুখে পড়েছে। দেশটির সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, তারা শ্রীলঙ্কায় লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ (এলপিএল) স্পন্সর করেছিল।
শ্রীলঙ্কা মিররে প্রকাশিত আজ মঙ্গলবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমটিএফই যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে, তা শ্রীলঙ্কায় নিষিদ্ধ এবং তারা নিবন্ধিত নয়। এলপিএলের দল জাফনা কিংসের জার্সিতে এমটিএফইর লোগো ছাড়াও তাদের বিজ্ঞাপন স্টেডিয়ামেও দেখা গেছে।
শ্রীলঙ্কা মিরর আরও জানায়, দেশটির অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতকে জানিয়েছে, এমটিএফই শ্রীলঙ্কার জনগণ থেকে ১০০ কোটি রুপি অবৈধভাবে তুলে নিয়েছে।
এমটিএফই সম্পর্কে যা জানা যায়
এমটিএফইর ‘গ্রাহকেরা’ বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি তাদের অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় শেয়ার, ডলার, ক্রিপ্টোকারেন্সি (ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা, যেমন বিটকয়েন) কেনাবেচাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় দিত।
প্রতারণার শিকার হওয়া বাংলাদেশিরা জানিয়েছেন, এমটিএফই তাদের মুঠোফোন অ্যাপে নিজের হিসাব খুলে মানুষকে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখাত। স্থানীয় প্রতিনিধিদের ব্যাংক হিসাব বা মুঠোফোনভিত্তিক লেনদেন ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা টাকা নিত। বিনিময়ে মানুষ মুঠোফোন অ্যাপে কিছু কিছু ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা লভ্যাংশ হিসেবে পেতেন। একপর্যায়ে অ্যাপ বন্ধ করে তারা চলে যায়।
এমটিএফই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় না। ইন্টারনেট ঘেঁটে কানাডাভিত্তিক গ্লোবাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল জার্নালে এমটিএফই সম্পর্কে দুটি নিবন্ধ পাওয়া যায়। যার একটি ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত। এতে বলা হয়েছে, এমটিএফই ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর প্রধান নির্বাহী র্যান্ডি ম্যাথিউ লেইন।
কানাডার ‘কোম্পানিজ ডিরেক্টরি’ নামের একটি ওয়েবসাইটে এমটিএফই সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন ব্যবসায়িক নিবন্ধন নম্বর, ঠিকানা এবং কত দিন ধরে তারা কানাডায় ব্যবসা করছে ইত্যাদি। এই সাইটটিতে এমটিএফইর দুজন পরিচালক থাকার কথা জানানো হয়েছে। এর মধ্যে একজন র্যান্ডি ম্যাথিউ লেইন, অন্যজন হংবিং ওয়াং। তবে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
কানাডায় সতর্কতা
কানাডার ওন্টারিও সিকিউরিটিজ কমিশন গত ৪ জুলাই তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৪টি কোম্পানির বিষয়ে সতর্কতা জারি করে। এতে বলা হয়, এসব কোম্পানি নিবন্ধিত নয় এবং তাদের সঙ্গে লেনদেন করা যাবে না। এই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশে আলোচনায় থাকা এমটিএফই।
কয়েকটি দেশে প্রতারণা করা একটি প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন কীভাবে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাল, প্রতিনিধি নিয়োগ দিল, বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থা ব্যবহার করে অর্থ লেনদেন করল, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, প্রলোভনে পড়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। নাগরিকদের সেখান থেকে রক্ষা করার জন্যই রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হয়েছে।