নতুন শর্তেও ব্যবসায়ীদের রমরমা মুনাফা

0
15

২০১২ সালের মার্চে উৎপাদনে আসে চট্টগ্রামের জুলদায় স্থাপিত ১০০ মেগাওয়াটের ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র। একর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কেন্দ্রটির চুক্তির মেয়াদ প্রথম দফা শেষে বাড়ে আরও পাঁচ বছর। এর পর গত ১০ বছরে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ৫ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ক্যাপাসিটি চার্জ।

বিদ্যুৎ বিক্রি হলেই শুধু বিল পাবে– এমন শর্তে ২০২২ সালের এপ্রিলে একর্নের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধি করে সরকার। বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এ সময়ে ভালোই ব্যবসা করছে তারা। চলতি অর্থবছরের হিসাব চূড়ান্ত হয়নি। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রটি থেকে ৬৫৬ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। পাঁচ বছরের চুক্তিতে এসে কোম্পানিটি এরই মধ্যে ১২ বছর ব্যবসা করেছে। তাদের মতো নতুন শর্তের আড়ালে বর্তমানে ১০টি রেন্টাল কেন্দ্র চালু রয়েছে। প্রতিটিই শত শত কোটি টাকা মুনাফা করছে। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ছয়টি কেন্দ্রের মেয়াদ আবারও দুই বছর বাড়ানো হচ্ছে।

চাহিদা না থাকার পরও এভাবে বারবার রেন্টাল কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকার পছন্দের ব্যবসায়ীদের বিনা টেন্ডারে বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে। এখন বারবার চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে তাদের ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছে। তাদের অভিযোগ, নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্টেও ক্যাপাসিটি চার্জের মতোই ব্যবসা হচ্ছে কেন্দ্র মালিকদের। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সঞ্চালন লাইনের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রাখতে এসব কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।

মেয়াদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় থাকা ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সামিটের মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট, ওরিয়নের মেঘনাঘাট ১০০ ও সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০, খুলনা পাওয়ার কোম্পানির (কেপিসিএল) নোয়াপাড়া ৪০ ও খুলনা ১১৫ এবং একর্নের জুলদা ১০০ মেগাওয়াট। কেপিসিএলের যৌথ মালিকানা হলো সামিট ও ইউনাইটেডের। এর মধ্যে মদনগঞ্জ কেন্দ্রের মেয়াদ গত ২২ মার্চ শেষ হয়েছে। মেঘনাঘাট, সিদ্ধিরগঞ্জ, নোয়াপাড়া ও খুলনা কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৩ মার্চ। জুলদা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল। এর বাইরে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ শর্তে চালু থাকা আরও চারটি রেন্টাল কেন্দ্র হলো সিনহা গ্রুপের আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট, পাওয়ার প্যাকের কেরানীগঞ্জ ১০০, ভোলায় ভেঞ্চার গ্রুপের ৪০ এবং এনার্জি প্রিমার ফেঞ্চুগঞ্জ ৪৪ মেগাওয়াট কেন্দ্র। এর মধ্যে আমনুরা ও কেরানীগঞ্জের দুটি ফার্নেস তেলচালিত। ভেঞ্চার ও প্রিমার দুটি গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ শর্তের আড়ালে উদ্যোক্তাদের কী সুবিধা সরকার দিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এ-সংক্রান্ত তথ্য উন্মুক্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে বিদ্যুৎ বিভাগের যুক্তি
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে ক্যাপটিভ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ২৪টি কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ক্রমান্বয়ে অবসরে পাঠানো হয়েছে। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রক্ষা, মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় কিছু কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৭৫৭ মেগাওয়াটের ৯টি এবং গ্যাসভিত্তিক ৫৫৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। গত ৬ মার্চ পিডিবির বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছয়টি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধির জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, গ্যাসের অপ্রতুলতায় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলে জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখা সহজ হবে। এ ছাড়া ঢাকা ও এর আশপাশ অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সিদ্ধিরগঞ্জ, মেঘনাঘাট ও মদনগঞ্জ রেন্টাল চালু রাখা প্রয়োজন। খুলনা অঞ্চলের কেপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি চালু রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে, জুলদা কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের হালিশহর ও শিকলবাহায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি চলমান সেচ ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে এই ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন।

বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতায় লোকসান
এবার গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ধরা হয় ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। কিন্তু দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি ৩৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে, গ্রাহক সেই হারে বাড়েনি। অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয় সরকারকে।
জানা গেছে, গত ১৪ বছরে বেসরকারি কেন্দ্রের পেছনে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে সরকারকে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয় কেন্দ্র মালিকদের, এটি ক্যাপাসিটি চার্জ।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকার কারণে বিদ্যুতে এ খাতে লোকসান বাড়ছে। এ ক্ষতি পোষাতে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে। তাদের মতে, অযাচিতভাবে পুরোনো কেন্দ্রের মেয়াদ না বাড়ালে লোকসান অনেক কম হতো।

পিডিবির একজন সাবেক প্রকৌশলী জানান, নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট শর্তে ক্যাপাসিটি চার্জ না থাকলেও নতুন চুক্তির সময় অপারেশন এবং মেইনটেন্যান্স (ওঅ্যান্ডএম) চার্জ বাড়ানো হয়েছে। এতে ক্যাপাসিটি চার্জের মতোই বিল আসছে।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধির মূল কারণ ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, ভুল নীতি ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সক্ষমতা। সরকার টেন্ডার ছাড়াই পছন্দের ব্যবসায়ীদের বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়েছে। এ খাতে কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, কত লাভ করছে– তা নিয়ে প্রশ্নও তোলার সুযোগ রাখেনি। আইন করে দায়মুক্তি দিয়েছে।

উদ্যোক্তাদের অতি মুনাফা
সামিটের মদনগঞ্জ কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসে ২০১১ সালের এপ্রিলে। পাঁচ বছর মেয়াদি কেন্দ্রটির প্রথম দফায় মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানো হয়। এই ১০ বছরে ৫ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা আয় করে কেন্দ্রটি। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ। ২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি মার্চ পর্যন্ত ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে চলে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২৭ কোটি টাকা আয় হয় এই কেন্দ্রের। ২০২৩-২৪ সালের হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি।

এভাবে ওরিয়নের সিদ্ধিরগঞ্জ কেন্দ্র ১২ বছর ধরে ব্যবসা করছে। ২০১১-১২ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত আয় হয়েছে ৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। গ্রুপটির মেঘনাঘাট রেন্টাল কেন্দ্র আয় করেছে ৬ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। কেপিসিএলের খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট ২০২২-২৩ পর্যন্ত ১৩ বছরে আয় করেছে ৬ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। কেপিসিএলের নোয়াপাড়ার কেন্দ্রটির গত অর্থবছর পর্যন্ত আয় ২ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। সিনহা গ্রুপের কেন্দ্রের আয় গত অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছর পর্যন্ত পাওয়ার প্যাকের কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রের আয় ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এই কেন্দ্রের মেয়াদ রয়েছে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত। ভেঞ্চার গ্রুপের ভোলা কেন্দ্রের আয় গত অর্থবছর পর্যন্ত ৮৮২ কোটি টাকা। ২০১২ সালের উৎপাদনে আসা এই কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ তিন দফা বেড়েছে। বর্ধিত মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালের জুলাইয়ে। এনার্জি প্রিমার ফেঞ্চুগঞ্জ কেন্দ্রের আয় ২০২২-২৩ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। ২০১২ সালের এই রেন্টাল কেন্দ্র এখনও চলছে।

চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই চলছে কেন্দ্র
ছয়টি রেন্টাল কেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছে। এখন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে। তার আগেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মৌখিক অনুমোদনে ছয়টি কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চলেছে। যদিও গত মার্চ ও এপ্রিলে কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। পিডিবির ওয়েবসাইটের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওরিয়নের সিদ্ধিরগঞ্জ কেন্দ্রটি ১১ জুন ৬৭ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.