
রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে যখন বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ে আনা হয়, তখনো তাঁরা জীবিত ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ৫ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও তাঁদের বাঁচাতে পারেনি।
ভিডিওতে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠে একটি ভ্যানের ওপর রাখা হয়েছে রূপলাল ও প্রদীপকে। চারপাশে কয়েক শ মানুষ, প্রথম সারিতে তরুণ-যুবকেরা। পুলিশের চার সদস্য ভ্যানটি ঘিরে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছিলেন এবং হাত তুলে জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। এ সময় রূপলাল দাঁড়াতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শোয়া অবস্থায় খুলে যাওয়া লুঙ্গি ঠিক করছিলেন তিনি। পুলিশ ধাক্কা দিয়ে জনতাকে সরানোর চেষ্টা করলে তাঁরা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। শোরগোল শুরু হলে পুলিশ পিটুনিতে অর্ধমৃত এই ব্যক্তিদের রেখে সরে যায়।

গত শনিবার রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জের সায়ার ইউনিয়নের বটতলা বুড়িরহাট এলাকায় দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই দুজন হলেন উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল দাস (৪০) ও তাঁর আত্মীয় মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া গ্রামের প্রদীপ লাল (৩৫)। রূপলাল স্থানীয় বাজারে জুতা সেলাই করতেন ও প্রদীপ লাল ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ চলে যাওয়ার পর রূপলাল মাথা তুলতেই কালো গেঞ্জি পরা এক যুবক তাঁকে ঘুষি মারেন। এতে আবার লুটিয়ে পড়েন রূপলাল। এরপর ভ্যানের ওপর শোয়া অবস্থায় থাকা দুজনকে তরুণ-যুবকেরা যে যেভাবে পারেন কিল, ঘুষি, লাথি, লাঠি ও রড দিয়ে মারতে থাকেন। একপর্যায়ে ভ্যানের ওপর থেকে মাটিতে পড়ে যান প্রদীপ লাল। এ দৃশ্য মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে ভিডিও করছিলেন অনেকেই।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রদীপ লাল ভ্যান থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সেখানে তাঁকে অনবরত লাথি মারা হয়। রূপলালকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভ্যানসহ প্রদীপ লালের ওপর উল্টে দেওয়া হয়। এতে দুজনই ভ্যানের নিচে চাপা পড়েন। এরপর তাঁদের ওপরে থাকা ভ্যানে চাপ দিতে থাকেন তাঁরা। এ সময় বাঁশির শব্দ শোনা গেলেও কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এ মরে নাই এ্যালাও। দে দে চাপা দে। আরও দে।’
একপর্যায়ে ভ্যানটি কয়েকজন যুবক-তরুণ রূপলাল ও প্রদীপের ওপর থেকে সরিয়ে নেন। এরপর রশি, জুতা, গাছের ডাল, ভ্যানের প্যাডেল দিয়ে মারধর করতে থাকেন। তখন নিস্তেজ ছিলেন রূপলাল ও প্রদীপ। মৃত্যু নিশ্চিত করতে হলুদ, কালো, লাল গেঞ্জি পরা চার-পাঁচজন তরুণ-যুবক রূপলালের পিঠে লাথি মারতে থাকেন। হলুদ গেঞ্জি পরা দুই তরুণ দুই পায়ে পিঠ বরাবর একাধিকবার লাথি দেন। এ সময় পাশে থাকে কয়েকজন বলতে থাকেন, ‘দে দে, আরও দে।’ প্রদীপ লালকে দেখিয়ে আঙুল উঁচিয়ে একজন বলতে থাকেন, ‘এ ওইটাকও দে। মার। নড়ি পা** ঢুকি দেও’ বলে উল্লাস করতে থাকেন। এ কথা শুনে এক হলুদ গেঞ্জি পরা তরুণ গাছের ডাল দিয়ে আরও মারতে থাকেন। ছাইরঙা গেঞ্জি পরা এক যুবক রূপলালের মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলায় পা তুলে দেন। আশপাশের কেউ কেউ তখন বলছিলেন, ‘পুলিশ পালাইছে।’

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মারধরে ১৫-২০ জন তরুণ-যুবক নেতৃত্ব দেন। প্রথমে পুলিশ সদস্যরা এলেও কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে ভয়ে তাঁরা চলে যান। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি যখন আসে, ততক্ষণে ঘটনাস্থলেই রূপলাল মারা যান। ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন পালিয়ে যান।
পুলিশ জানায়, তাঁদের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে রোববার ভোর চারটায় তাঁর মৃত্যু হয়।
মামলার বেশি আসামি নিয়ে প্রশ্ন
এ ঘটনায় নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী রোববার দুপুরে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ময়নাতদন্ত শেষে রূপলালের লাশ বাড়িতে এলে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে স্থানীয়রা রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে লাশ রেখে অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। তাঁরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জড়িতদের গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেন। ওই রাতে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন বালাপুর এলাকার এবাদত হোসেন (২৭), বুড়িরহাট এলাকার আক্তারুল ইসলাম (৪৫), রফিকুল ইসলাম (৩৩) ও রহিমাপুরের মিজানুর রহমান (২২)।
ঘটনার পর পুরো এলাকা গ্রেপ্তার–আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাজারের নিরপরাধ ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষদের আতঙ্কে না থাকার জন্য আশ্বস্ত করতে সেখানে যান বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
বুড়িরহাট বাজারে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে পথসভায় তারাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান শিপু বলেন, ‘যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, উসকানি দিয়েছে, সরাসরি ওই দুই ব্যক্তিকে মেরেছে তারাই অপরাধী। অনেকে তো বাঁচাতে গেছে, তাদের অপরাধী বলা যাবে না। এলাকার মানুষ যদি দোষী হয়, তাহলে প্রথমে পুলিশই দোষী। কেননা, দুই ভ্যান পুলিশ এসে বাঁচায়নি, পালিয়ে গেছে। অহেতুক ৭০০ জনের নামে মামলা—এটা কি ব্যবসা করার জন্য? মানুষকে আতঙ্কে রেখে টাকা নেওয়ার সুযোগ আমরা দেব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা অপরাধী, আমরা তাদের সুপারিশ করব না। উসকানি দিয়েছে ২০-২৫ জন, সাধারণ মানুষ জড়িত নয়। নির্ভয়ে ব্যবসা করবেন, বাসায় থাকবেন। কেউ হয়রানি করলে দাঁতভাঙা জবাব দেব।’
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, ঘটনাস্থলে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন। এর বিপরীতে সেখানে চারজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তাঁরা তাঁদের (রূপলাল ও প্রদীপ) বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পেছন থেকে যখন পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি, ঘুষাঘুষি শুরু হয় তখন তাঁরা জীবনের ভয়ে সরে এসেছেন। পুলিশের করার কিছু ছিল না। ভিডিও দেখে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ওসি।
রহিদুল মিয়া
তারাগঞ্জ, রংপুর