
৮ মে রাত আটটার কিছু পর ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় শহর জম্মুর আকাশে লাল রঙের আলোর শিখা ছুটে যেতে দেখা যায়। এ সময় তা লক্ষ্য করে শহরটির বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গুলি চালাতে শুরু করে। সেগুলো ছিল পাকিস্তান থেকে আসা ড্রোন।
গত কয়েক দশকে নিজেদের মধ্যে হওয়া একাধিক সংঘর্ষে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী একে অন্যের বিরুদ্ধে উন্নত মানের যুদ্ধবিমান, প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে। কিন্তু মে মাসে টানা চার দিনের সংঘর্ষে প্রথমবারের মতো নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ ব্যাপকভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর প্রতিবেশী ওই দেশ দুটির মধ্যে সংঘর্ষ থামে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার এ দুই শক্তি এখন ড্রোনকে ঘিরে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছে। রয়টার্সের নেওয়া দুই দেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তা, শিল্প নির্বাহী, বিশ্লেষকসহ ১৫ জনের সাক্ষাৎকারে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ভারত ও পাকিস্তান গত বছর প্রতিরক্ষা খাতে ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেশি খরচ করেছে।
পাকিস্তান বিমানবাহিনী আরও বেশি ইউএভি সংগ্রহের চেষ্টা করছে, যাতে তাদের মূল্যবান উন্নত প্রযুক্তির বিমানগুলো ঝুঁকিতে না পড়ে।
ড্রোন ফেডারেশন ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা স্মিত শাহ বলেন, ভারত স্থানীয় শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে। ইউএভি (ড্রোন) খাতে আগামী ১২ থেকে ২৪ মাসে প্রায় ৪৭ কোটি ডলার ব্যয় করা হতে পারে, যা সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের আগের ব্যয়ের প্রায় তিন গুণ।
এ মাসে ভারত জরুরি সামরিক সরঞ্জাম কিনতে প্রায় ৪৬০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে। এ তথ্য দুজন শিল্প–বিশ্লেষকও নিশ্চিত করেছেন। অর্থাৎ ভারত জরুরিভিত্তিতে বড় অঙ্কের সামরিক কেনাকাটা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে অবগত দুজন ভারতীয় কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত তহবিলের কিছু অংশ যুদ্ধ ও নজরদারিতে ব্যবহৃত ড্রোনের জন্য বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে ভারতের সামরিক বাহিনী।
ভারতে সাধারণত বছরব্যাপী প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষাসামগ্রী ক্রয় করা হয়। তবে ভারতীয় ইউএভি কোম্পানি আইডিয়াফোর্জ টেকনোলজির ভাইস প্রেসিডেন্ট বিশাল সাক্সেনা বলেছেন, এখন সরকার অত্যন্ত দ্রুততম গতিতে ড্রোন নির্মাতাদের ড্রোন পরীক্ষা ও প্রদর্শনীর জন্য ডেকে পাঠাচ্ছে।
ভারত স্থানীয় শিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে। ইউএভি (ড্রোন) খাতে আগামী ১২ থেকে ২৪ মাসে প্রায় ৪৭ কোটি ডলার ব্যয় করা হতে পারে, যা সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের আগের ব্যয়ের প্রায় তিন গুণ।
অন্যদিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনী আরও বেশি ইউএভি সংগ্রহের চেষ্টা করছে, যাতে তাদের মূল্যবান উন্নত প্রযুক্তির বিমানগুলো ঝুঁকিতে না পড়ে। এমন তথ্য জানিয়েছে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত একটি পাকিস্তানি সূত্র।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় পাকিস্তান ও ভারত দুপক্ষই আধুনিক ৪ দশমিক ৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ইসলামাবাদের কাছে চীনের নির্মিত প্রায় ২০টি উন্নত মানের জে-১০ যুদ্ধবিমান আছে, যা (যুদ্ধবিমান) ভারতের তুলনায় কম। দেশটির কাছে ফ্রান্সের নির্মিত ৩০টির বেশি রাফাল যুদ্ধবিমান আছে।

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা জেনেসের ওইশি মজুমদার বলেন, চীন ও তুরস্কের সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করে দেশীয় ড্রোনের গবেষণা ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করবে পাকিস্তান।
পাকিস্তানি একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসলামাবাদ পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পার্ক ও তুর্কি প্রতিরক্ষা কন্ট্রাক্টর বায়কারের সহযোগিতায় ইহা-৩ ড্রোন দেশীয়ভাবে সংযোজন করছে। দেশীয়ভাবে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে একটি ড্রোন তৈরি করা সম্ভব।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় পাকিস্তান ও ভারত দুপক্ষই আধুনিক ৪ দশমিক ৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ইসলামাবাদের কাছে চীনের নির্মিত প্রায় ২০টি উন্নত মানের জে-১০ যুদ্ধবিমান আছে, যা (যুদ্ধবিমান) ভারতের তুলনায় কম। দেশটির কাছে ফ্রান্সের নির্মিত ৩০টির বেশি রাফাল যুদ্ধবিমান আছে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রয়টার্সের এ–সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও বায়কারও মন্তব্য করার অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
কিংস কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান ড্রোন হামলাকে বড় ধরনের উত্তেজনা ছড়ানো ছাড়াই সামরিক চাপ প্রয়োগের একটি উপায় হিসেবে দেখছে বলে মনে হচ্ছে।’
ল্যাডউইগ বলেন, ইউএভিগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এগুলো ব্যবহার করে কোনো দেশ তাদের শক্তি দেখাতে পারে, নিজেদের জনগণকে সন্তুষ্ট রাখতে পারে, আবার বড় ধরনের যুদ্ধের ঝুঁকি ছাড়া শত্রুপক্ষকে চাপে রাখতে পারে। তবে এ ধরনের সংঘর্ষ পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নয়। কারণ, বিতর্কিত বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ড্রোন পাঠালে ভুলক্রমে বড় ক্ষতি হতে পারে।
গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। ভারত এ হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। তবে পাকিস্তান এ অভিযোগ পুরোপুরিভাবে নাকচ করে দিয়েছে। এ হামলার জেরে মে মাসে দুই দেশের মধ্যে চলতি দশকের সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেন। এরই অংশ হিসেবে ৭ মে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায় ভারত।
পরের রাতেই পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার (৭৭২ মাইল) সীমান্তজুড়ে একঝাঁক ড্রোন পাঠায়। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেন, ভারতের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পরখ করতে ৩৬টি স্থানে ৩০০ থেকে ৪০০টি ড্রোন পাঠানো হয়েছিল।
দুই পাকিস্তানি সূত্র জানায়, পাকিস্তান তুরস্কের ইহা-৩ ও অ্যাসিসগার্ডের সোনগার ড্রোনের ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত রাষ্ট্রায়ত্ত গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ডিফেন্স সলিউশনের তৈরি শাহপার-৩ ড্রোন ব্যবহার করে পাকিস্তান।
তবে দুই ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, স্নায়ুযুদ্ধ-যুগের পুরোনো যুদ্ধবিমান–বিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানের পাঠানো ড্রোনের বেশির ভাগই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান এ দাবি অস্বীকার করেছে। আবার পাকিস্তানের ড্রোন হামলায় ভারত কোনো বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলেও মনে হচ্ছে না।
ভারত ও পাকিস্তান ড্রোন হামলাকে বড় ধরনের উত্তেজনা ছড়ানো ছাড়াই সামরিক চাপ প্রয়োগের একটি উপায় হিসেবে দেখছে বলে মনে হচ্ছে।
ভারতীয় অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার অংশুমান নারাং বর্তমানে দিল্লির সেন্টার ফর জয়েন্ট ওয়ারফেয়ার স্টাডিজে ইউএভি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের বিমানবিধ্বংসী কামানগুলো ড্রোন যুদ্ধের জন্য নকশা করা হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এগুলো কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। আমি যেমন আশা করেছিলাম, তার চেয়ে এগুলো ১০ গুণ ভালো।’
একটি ভারতীয় ও দুটি পাকিস্তানি সূত্র অনুসারে, ভারত পাকিস্তানের আকাশসীমায় ইসরায়েলি হারপ (আত্মঘাতী ড্রোন), পোলিশ ওয়ারমেট (ক্ষুদ্রাকৃতির আত্মঘাতী ড্রোন) ও দেশীয়ভাবে উৎপাদিত মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ইউএভি) পাঠিয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি ইউএভি সামরিক ও ‘সন্ত্রাসী’ ঘাঁটিতে নির্ভুলভাবে হামলার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন দুই ভারতীয় কর্মকর্তা।
পাকিস্তানের দুটি নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভারত বিপুল হারপ ড্রোন মোতায়েন করে। ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ দূরপাল্লার এসব আত্মঘাতী ড্রোন তৈরি করেছে। অস্ত্রসজ্জিত এসব ড্রোন নির্দিষ্ট এলাকার আকাশে দীর্ঘ সময় ধরে চক্কর দিতে ও লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালিয়ে নিজেকে বিস্ফোরিত করতে পারে।
পাকিস্তানের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তান কিছু এলাকায় হারপ ড্রোনগুলোকে ভুয়া রাডারের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলেছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশটির সামরিক বাহিনী এগুলোর জ্বালানি শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে, যাতে এগুলো তিন হাজার ফুট নিচে নেমে এলে গুলি করে ভূপাতিত করা যায়।
উভয় পক্ষই ইউএভি ব্যবহারে বিজয় অর্জনের দাবি করেছে।
কিংস কলেজ লন্ডনের ল্যাডউইগ বলেছেন, কম ঝুঁকিতে সেনা বা বড় ধরনের সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার না করেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবকাঠামোয় সফলভাবে নিশানা করেছে ভারত। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও ইউএভি দিয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা অবকাঠামোয় হামলার দাবি করেছে। ড্রোন হামলার মাধ্যমে তারা মূলত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সংকেত দিতে পেরেছে। প্রচলিত যুদ্ধবিমানের পরিবর্তে ড্রোন ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মহলের নজরও এড়ানো সম্ভব হয়েছে।

অনেক ড্রোন ধ্বংস হওয়ার পরও উভয় পক্ষই দ্বিগুণ উদ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘আমরা অপেক্ষাকৃত সস্তা প্রযুক্তির কথা বলছি।’
ইউএভিগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের মতো চমকপ্রদ প্রভাব তৈরি করতে না পারলেও এগুলো প্রতিপক্ষকে শক্তি ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের বার্তা দিতে পারে।
ভারতীয় নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র ও ভারতীয় ইউএভি নির্মাতা নিউস্পেসের সামির জোশি বলেছেন, ভারতীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকারীরা সম্ভবত আকাশ চক্কর দিতে পারা উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রসজ্জিত আত্মঘাতী ড্রোনের দেশীয় উন্নয়নকাজের সম্প্রসারণ ঘটাবে। তারা এ ধরনের ড্রোনের উন্নয়নে আরও গভীরভাবে কাজ করছেন।
জোশির প্রতিষ্ঠান ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ইউএভি সরবরাহ করে। তিনি বলেন, আত্মঘাতী ড্রোনগুলো দীর্ঘক্ষণ শত্রুপক্ষের আকাশসীমায় ঘুরে বেড়াতে পারে, সহজে ধরা পড়ে না ও নিশানায় নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারে। এসব গুণের কারণে এখন যুদ্ধের ধরন বদলাচ্ছে। আগের মতো দামি যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র না পাঠিয়েও এখন অনেক কম খরচে বেশি কার্যকরভাবে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা যাচ্ছে।
আইডিয়াফোর্জের কর্মকর্তা সাক্সেনা বলেন, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে দুই হাজারের বেশি ইউএভি সরবরাহ করা এই প্রতিষ্ঠানের মতো অন্য কোম্পানিগুলোও তাদের ড্রোনগুলোকে ইলেকট্রনিক যুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য হিসেবে গড়ে তুলতে বিনিয়োগ করছে।
রয়টার্স
নয়াদিল্লি/ইসলামাবাদ