১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। কোন অভিযোগে বায়েজাপ্ত হয়েছিল বিদ্রোহী কবির বইগুলো, আজ নজরুলজয়ন্তীতে জানা যাক সেই অধ্যায় সম্পর্কে।
সময়টা ১৯২২ সাল। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা অফিসে সকাল সকাল আড্ডা জমেছে। অনেকের সঙ্গে সেদিন সেখানে উপস্থিত কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ। হঠাৎ দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে একসঙ্গে অনেক জুতার শব্দ শুনে আড্ডা ভাঙল। মুজফ্ফর আহ্মদের কথায়, ‘পুলিশ এসেছে “ধূমকেতু”র অফিসে তল্লাশি ও কাজী নজরুলের নামে গ্রেপ্তারের পরওয়ানা নিয়ে।…নজরুল তখন কলকাতায় নেই গিয়েছে সমস্তিপুরে, পুলিশ আমাদের গভার্মেন্ট অর্ডার দেখালো যে, ২৬ সেপ্টেম্বর (১৯২২) তারিখের “ধূমকেতু”তে প্রকাশিত “আনন্দময়ীর আগমনে” (কাজী নজরুলের লেখা) শীর্ষক কবিতা ও “বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ” (অধ্যাপক শ্রী সাতকড়ি মিত্রের ছোট বোনের লেখা) শীর্ষক একটি ছোট লেখা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে।’
তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে পুরো ভারতে। স্বাধীন ভারতে স্বাধীনতার দাবি জোরালো হচ্ছে ধীরে ধীরে। লেখক-বুদ্ধিজীবীরা লিখে যাচ্ছেন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে, জোরালো দাবি জানাচ্ছেন ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে।
একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শাসকদের নির্যাতন, নিপীড়ন। নিষিদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন লেখকের বইপত্র, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। অনেকের মতো দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় নজরুলের বই। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা ও প্রবন্ধের বই। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সংবাদ সংগ্রহের জন্য পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয় গোয়েন্দা।
একদিনের ঘটনা, নজরুল গেছেন কবি সুফিয়া কামালের বাড়িতে। বসেছে গানের আসর। সেখানে একজন গোয়েন্দাও ছিলেন। তাঁর উদ্দেশে নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি, জানি ঠিকঠিকিই।’ ব্যঙ্গ কবিতা শুনে গোয়েন্দাটি রাগ করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, ‘দাদু, তুমি একে চিনলে কী করে?’
‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’—নজরুলের উত্তর।
১৯২২ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত না হলেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাঁর আরও কিছু বই।
নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয়, তার নাম ‘যুগবাণী’। ১৯২২ সালে ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারানুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তৎকালীন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ‘যুগবাণী’কে একটি ভয়ংকর বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, লেখক বইটির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন। ‘ক্রীতদাস মানসিকতার’ ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শাসনভার দখলের মন্ত্রণা জোগাচ্ছেন। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন ‘যুগবাণী’।
এর ঠিক দুই বছর পর ১৯২৪ সালে নজরুলের দুটি কবিতার বই পরপর নিষিদ্ধ হয়। প্রথমে ‘বিষের বাঁশি’; তৎকালীন বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক অক্ষয়কুমার দত্তগুপ্ত পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘লেখক “বিষের বাঁশি”র মাধ্যমে তাঁর বিপ্লবী অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং তরুণদের বিদ্রোহ করতে এবং আইন অমান্য করতে প্ররোচনা দিচ্ছেন…।’ অপরাধ তদন্ত বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে প্রকাশনাটির দিকে দৃষ্টি দিতে সুপারিশ করেন তিনি। দত্তগুপ্তের সুপারিশ বিফলে যায়নি। ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবরের গেজেট ঘোষণায় ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ হয়।
‘বিষের বাঁশি’র প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি ছিল অপূর্ব। একটি কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে বিশাল এক বিষধর সাপ। কিন্তু কিশোরের চোখেমুখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। আর তার বাঁশির সুরে জেগে উঠছে নতুন দিনের সূর্য। এরপর ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয় ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর।
নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও বই দুটির প্রচার বন্ধ করা যায়নি। কবিতার বই দুটি সংগ্রহে যুবকদের আগ্রহের অন্ত ছিল না। ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’–এর সুরে তরুণেরা তখন মাতোয়ারা।
‘প্রবাসী’র মতো অভিজাত পত্রিকা ‘বিষের বাঁশি’র প্রশংসা করে লিখেছিল, ‘কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচণ্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মুত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।’
এরপর সরকারি রোষের কোপে পড়ে কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয়–শিখা’। কবির মনোজগতে তখন তোলপাড় চলছে। প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা গেছে। বিদ্রোহ-বিপ্লবের পুরোধা কবি কেঁদে কেঁদে আকুল। চোখে জল, কিন্তু বুকে আগুন। সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল ‘প্রলয়–শিখা’র প্রতিটি শব্দে। বিদ্যুতের গতিতে ‘প্রলয় শিখা’ ছুটল পুরো বাংলায়। পুলিশ গোয়েন্দাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। গোপন বার্তা ত্বরিত চালাচালি হতে লাগল। তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু ‘প্রলয়–শিখা’ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে তৎকালীন কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান, বইটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১৫৩এ ও ১২৪এ ধারা ভঙ্গ করেছে।
তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরামর্শ দেন তিনি। এর ভিত্তিতে সেই সময়কার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বইটিকে অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করার জন্য ১৯৩০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মুখ্য সচিবকে জরুরি চিঠি দেন। ‘প্রলয়–শিখা’ আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে।
‘প্রলয়–শিখা’র রেশ কাটতে না কাটতে বাজেয়াপ্তের খড়্গ নেমে আসে ‘চন্দ্রবিন্দু’র ওপর। এটি মূলত ব্যঙ্গ–বিদ্রূপের কবিতার বই। তৎকালীন সময়ের সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস ফুটে উঠেছে এর প্রতি ছত্রে। বইটির দুটি কবিতা পড়া যাক—
‘মসজিদ পানে ছুটিলেন মিঞা মন্দির পানে হিন্দু,
আকাশে উঠিল চির জিজ্ঞাসা করুণ চন্দ্রবিন্দু।’
‘কাফ্রি চেহারা ইংরিজি দাঁত,
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা অস্ত্র আইন বাঁচাতে।’
‘চন্দ্রবিন্দু’ নিষিদ্ধ হয় ‘প্রলয়–শিখা’ নিষিদ্ধ হওয়ার এক মাস পর ১৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে। নজরুলের অন্যান্য নিষিদ্ধ বইয়ের মতো এটিও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৯৯এ ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
উল্লিখিত পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও ‘অগ্নিবীণা’, ‘ফণিমনসা’, ‘সঞ্চিতা’, ‘সর্বহারা’, ‘রুদ্রমঙ্গল’ প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এগুলো বাজেয়াপ্ত হয়নি।