‘অবৈধ’ আয়ে জমি–ফ্ল্যাট, দুদকের জালে স্বামী–স্ত্রী

0
114
মুহাম্মাদ গালীব খান

সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মাদ গালীব খান ও তাঁর স্ত্রী বড় অঙ্কের অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। এখন তাঁরা দুদকের জালে।

  • গালীব খান ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদক অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে আলাদা দুটি মামলা করেছে।
  • সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপকমিটিতে গালীবের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।

    স্বামী ও স্ত্রী মিলে জমি কিনেছেন, ফ্ল্যাট কিনেছেন, গাড়ি কিনেছেন। বিনিয়োগ করেছেন শেয়ারবাজারে। ব্যাংকেও রেখেছেন বড় অঙ্কের টাকা। কিন্তু এসব টাকা তাঁদের আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এই দম্পতি এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে।

    স্বামীর নাম মুহাম্মাদ গালীব খান, যিনি সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক। তাঁর স্ত্রীর নাম তানিয়া সুলতানা ওরফে রাখি। তিনি বেসরকারি একটি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট।

    গালীব খান ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদক গত ১২ অক্টোবর অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে আলাদা দুটি মামলা করেছে। মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে মোট ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

    ধানমন্ডিতে তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফরিদপুরে তিনি আড়াই একরের বেশি জমি কিনেছেন। ব্যাংকে টাকা, সঞ্চয়পত্র ও গাড়ি রয়েছে তাঁর। সব মিলিয়ে তানিয়া সুলতানার সম্পদের মূল্য প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। তিনি ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

    দুদক মামলা করেছে প্রাথমিক অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে। এখন মামলার তদন্ত চলছে। সমবায় অধিদপ্তর সূত্রের অভিযোগ, গালীব খান সমবায় সমিতিতে অনিয়মের সুযোগ দিয়ে এবং নিয়োগ-বাণিজ্য করে অবৈধ আয় করেছেন। সেই আয় দিয়ে সম্পদ অর্জন করেছেন।

    অধিদপ্তরে এখন একটি নিয়োগপ্রক্রিয়া চলছে। সেখানেও কোনো কোনো অসাধু কর্মকর্তা প্রার্থীদের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বড় অঙ্কের অর্থ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

    গালীব খান তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অধীনস্থ এক কর্মচারীর দুর্নীতিতে বাধা দেওয়ায় ওই কর্মচারী দুদকে কর্মরত তাঁর এক আত্মীয়কে দিয়ে মামলা করিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিলে মাসে পাঁচ লাখ টাকা বেতন পান। তিনি শেয়ার ব্যবসাও করেন। সেই টাকা দিয়ে এবং ব্যাংক ঋণ নিয়ে তাঁরা সম্পদ গড়েছেন।

    অবশ্য দুদকের দুটি মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কয়েকটি ক্ষেত্রে বৈধ আয় ও সেই আয় দিয়ে সম্পদ অর্জনের প্রমাণ গালীব খান ও তাঁর স্ত্রী দেখাতে পারেননি। তাঁদের আয় ও সম্পদের মূল্য পর্যালোচনা করেই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের হিসাব পাওয়া গেছে।

    গালীব খান ও তানিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে মামলা দুটি করেছিলেন দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। তিনি বলেন, অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

    গালীবের কত সম্পদ

    সমবায় অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ২৩ নভেম্বর গালীব খান বিসিএস সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সমবায় অধিদপ্তরে সহকারী নিবন্ধক হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬ সালে তিনি জেলা সমবায় কর্মকর্তা হন। ২০১৮ সালে উপনিবন্ধক হিসেবে পদোন্নতি পান।

    অভিযোগ রয়েছে, গালীব খান জেলা সমবায় কর্মকর্তা থাকাকালে ২০১৭ সালে ডেসটিনি ও মমতা সমবায় সমিতির দুই শীর্ষ নেতার যোগসাজশে ওই সমবায় সমিতি দুটি থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন। দুদকের মামলার এজাহার বলছে, গালীব খান রাজধানীর খিলগাঁওয়ের জমি কিনে সেখানে ১ হাজার ৪১৬ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট (যৌথভাবে) মালিক হয়েছিলেন। তিনি ফরিদপুরে ৬২ শতাংশ জমি কিনেছেন। তাঁর ব্যাংকে জমা টাকা ও সঞ্চয়পত্র রয়েছে।

    গালীব খানের যে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে, তার দাম প্রায় ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বিপরীতে তিনি বেতন-ভাতা বাবদ ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত আয় দেখিয়েছেন প্রায় ৬২ লাখ টাকা, যা মাসে গড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার টাকা। তিনি চাকরির ভবিষ্য তহবিলের (প্রভিডেন্ট ফান্ড) সুদ বাবদ ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা, ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের সুদ বাবদ ৭৬ হাজার, জমি বিক্রি থেকে ৯ লাখ ৮৭ হাজার এবং শেয়ারবাজারের বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ বাবদ প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা আয় দেখিয়েছেন।

    দুদক বলছে, গালীব খান জমি বিক্রি থেকে আয়ের বিপরীতে দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি। ভবিষ্য তহবিলের সুদ তাঁর সম্পদ, যা তহবিলের মূল টাকার সঙ্গে যোগ হয়। এটা আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত নয়। শেয়ারবাজার থেকে তিনি যে আয় দেখিয়েছেন, তার আগেই সম্পদ অর্জন করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর ২ কোটি ১৪ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের বৈধ উৎস নেই। গত বছরের অক্টোবরে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে গালীব খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।

    স্ত্রীর নামে সম্পদ বেশি

    গালীব খানের স্ত্রী তানিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলায় বলা হয়, তিনি রাজধানীতে সাড়ে তিন কাঠা করে দুটি প্লটের মালিক। ধানমন্ডিতে তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফরিদপুরে তিনি আড়াই একরের বেশি জমি কিনেছেন। ব্যাংকে টাকা, সঞ্চয়পত্র ও গাড়ি রয়েছে তাঁর। সব মিলিয়ে তানিয়া সুলতানার সম্পদের মূল্য প্রায় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। তিনি ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

    গালীব খান ও তানিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে মামলা দুটি করেছিলেন দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। তিনি বলেন, অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

    গালীব খান ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মোছা. ফাহমিদা আকতার বলেন, মামলা দুটির তদন্ত চলছে। মামলায় উল্লেখ করা তথ্যের বাইরে এই দম্পতির আরও অবৈধ সম্পদ আছে কি না, তা খোঁজা হচ্ছে।

    সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থা নিতে বলেছিল

    স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপ-কমিটিতে ২০১৮ সালে গালীব খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এতে বলা হয়, গালীব খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সমবায় অধিদপ্তরকে সুপারিশ করা হয়েছিল। দুদকও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কর্তৃপক্ষ তাঁকে জেলা সমবায় কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি দিয়ে উপনিবন্ধক করেছে।

    সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তরুণ কান্তি সিকদার বলেন, গালীব খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। সেখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ায় পর তিনি পদোন্নতি পান। তিনি বলেন, তদন্ত শেষে দুদক গালীব খানের মামলায় অভিযোগপত্র দিলে তাঁর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

    সমবায় অধিদপ্তর ২০১৭ সালে একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করার পর তা ফেরত দেয়নি ২৬৬টি সমবায় সমিতি। এসব সমিতির বেশির ভাগ তাদের কার্যালয় বন্ধ করে পালিয়েছে। সারা দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত উধাও হয়ে যাওয়া সমিতিগুলোর ওপর ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

    সমবায় সমিতির এ অনিয়মের পেছনে সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কারও কারও যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমবায় অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সমবায়ে অসাধু কর্মকর্তাদের একটি চক্র রয়েছে। এই চক্র সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করে ফেলে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.